পঙ্কজ চট্টোপাধ্যায়
“তারা আকাশে, মাটিতে, শত্রুঘাঁটিতে, বিদ্রোহের অগ্নিস্ফুলিঙ্গে সেদিন, বারেবারে তুলেছিল আগুন ঝড়…
ওগো আমার মাতৃভাষা, ওগো আমার জন্মভূমি, তারা..তোমার দামাল দস্যি ছেলে-মেয়েরা শহীদের বুকের রক্ত দিয়ে, ইতিহাস লিখেছিল তারপর. …”
বিবস্বানের এই ছত্রগুলি আজ মনে করিয়ে দেয় ১৯৫২ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারীর কথা,১৯৬১ সালের ১৯ শে মে-র কথা,১৯৭২ সালের ১৭ই আগস্টের কথা,১৯৮৬ সালের ২১শে জুলাইয়ের কথা, এই দুই বাংলা সহ সারা বিশ্বজুড়ে মাতৃভাষা আন্দোলনের কথা,সেইসব রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মৃত্যুঞ্জয়ী শহীদদের কথা।
আমরা সবাই জানি ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারিতে(বৃহস্পতিবার/ ৮ই ফাল্গুন,১৩৫৮ বঙ্গাব্দ) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চত্ত্বরে বংলা ভাষা আন্দোলনের শহীদ হয়েছিলেন রফিকউদ্দিন আহমেদ, আবুল বরকত, আবদুল জব্বার, শফিউর রহমান সহ ১১ জন বাংলা মায়ের সন্তান,আমার আপনার ভাই বেরাদর।তারপর থেকে এই ২১শে ফেব্রুয়ারী এক ইতিহাস। তবে সেই ইতিহাসকে বিশ্বের ইতিহাসের প্রথম পাতায় আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে প্রতিষ্ঠ করার পেছনে আরও বেশ কয়েকজন রয়েছে, যাদের নামই আমরা জানিনা।তাদের কথাই আজ এখানে বলবো।
২১শে ফেব্রুয়ারী এই ঐতিহাসিক দিনটিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি প্রতিষ্ঠা করার যে কাজ,সেই কাজ প্রথমে শুরু করেন কানাডার ভ্যাঙ্কুউভারের দুই প্রবাসী বাঙালী রফিকুল ইসলাম এবং আব্দুস সালাম।তারাই প্রথম সেইসময়কার রাষ্ট্র সঙ্ঘের মহাসচিব মিঃ কোফি আন্নান-কে ২১শে ফেব্রুয়ারী দিনটিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য একটি আবেদন পত্র পাঠান ১৯৯৮ সালে। সেই আবেদন পত্রটি সেই সময়ে কোফি আন্নানের তথ্য সচিব হাসান ফিরদৌস-এর নজরে আসে। তিনি ১৯৯৮ সালেরই ২০জানুয়ারী রফিক এবং আব্দুস কে চিঠি দিয়ে জানান যে,একটি সংগঠন তৈরী করে তার মারফৎ এই আবেদনটি করতে। সেইমতন রফিক,আব্দুস “Mother’s language lovers’ of the World ” নামে একটি নতুন সংগঠন তৈরী করেছিলেন। তারপর তাতে যুক্ত হন একজন ইংরাজি ভাষার মানুষ, একজন জার্মান ভাষার মানুষ, একজন কাচ্চি ভাষার মানুষ, একজন ক্যান্টোনিজ ভাষার মানুষ। তখন সবাই মিলে ” A group of Mother language lovers’ of the World “এর পক্ষ থেকে প্রস্তাবটি আবার পাঠান। এবং প্রস্তাবটির এককপি UNO তে কানাডার প্রতিনিধি মিঃ ডেভিড ফাওলারের কাছেও পাঠান।
এরপর তারা ১৯৯৯ সালে UNO-র মিঃ জোশেফ এবং UNESCO-র মিস.আনা মারিয়ার সাথে দেখা করেন।
এরপর মিস.আনা মারিয়ার প্রস্তাব মতো সেই আবেদনটিকে সমর্থন জানায় কানাডা, হাঙ্গেরি, ভারতবর্ষ, ফিনল্যান্ড, এবং বাংলাদেশ রাষ্ট্রগুলি।
১৯৯৯ সালের ১৭ই নভেম্বর UNESCO- র প্যারিস অধিবেশনে সেই প্রস্তাবটিকে বিশ্বের ১৮৮ টি দেশ সরকারিভাবে সমর্থন জানায়। এবং ২০০০ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারী থেকে যথাযথ সম্মানের সাথে দিনটি “আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস” হিসাবে পালিত হতে শুরু করে।
এই আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে স্মরণ করতে হয় ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারীর অমর শহীদ দের,স্মরণ করতে হয় ১৯৪৩ সালে আফ্রিকার ভাষা আন্দোলনের শহীদদের, স্মরণে শ্রদ্ধা জানাতে হয় ল্যাটিন আমেরিকার দেশগুলোর ভাষা আন্দোলনের শহীদ সন্তানদের। আয়ারল্যান্ড-এর ভাষা আন্দোলনের বীর যোদ্ধাদের(যার সাথে ভগিনী নিবেদিতার পিতামহ যুক্ত ছিলেন),স্মরণ করতে হয় ১৯৬১ সালের ১৯ শে মে-র এই ভারতের আসাম প্রদেশের বরাকর উপত্যকায় বাংলা ভাষার সম্মানের দাবীতে শহীদ হওয়া ১২ জনকে( কানাইলাল নিয়োগী,চণ্ডীচরণ সুত্রধর,হিতেশ বিশ্বাস,সত্যেন্দ্র কুমার দেব, কুমুদরঞ্জন দাস, সুনীল সরকার, তরনী দেবনাথ, শচীন্দ্র চন্দ্র পাল,বীরেন্দ্র সুত্রধর,সুকোমল পুরকায়স্থ, কৃষ্ণকান্ত বিশ্বাস,এবং কমলা ভট্টাচার্য। স্মরণে রাখতে হয় ১৯৭২ সালের ১৭ ই আগস্ট করিমগঞ্জ-এর শহীদ বিজন চক্রবর্তীকে,১৯৮৬ সালের ২১শে জুলাই বাংলা ভাষার দাবীতে শহীদ হওয়া করিমগঞ্জ-এর জগন্ময় দেব এবং দিব্যেন্দু দাস-কে।স্মরণ করতে হয় দেশে দেশে জনজাতি, আদিবাসী এবং নানান ভাষার মানুষদের তাদের মাতৃভাষার স্বীকৃতির দাবীতে নাম জানা,নাম না জানা অমর শহীদদের।
আরও কত ইতিহাস রয়েছে এই বিশ্বের পদপ্রান্তে, যা হয়ত আমাদের অজানা রয়ে গেছে।সেইসব ভাষা আন্দোলনের শহীদদের স্মরণ করাই হবে ২১শে ফেব্রুয়ারী “আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা” দিবসের একান্ত এবং আন্তরিক শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার কৃতজ্ঞতায় প্রণম্য স্মৃতি তর্পণ।
“আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো ২১শে ফেব্রুয়ারী, আমি কি ভুলিতে পারি….” না, ভুলতে পারি না, ভোলা যায় না, তোমাদের, ওগো আমার শহীদ ভাই-বোনেরা…তোমরা ঘুমাও… আমরা জেগে আছি মাতৃভাষার অতন্দ্র প্রহরায়…।