প্রথম পাতা প্রবন্ধ ঠাকুর পুজো…

ঠাকুর পুজো…

919 views
A+A-
Reset

পঙ্কজ চট্টোপাধ্যায়

খুব শরীর খারাপ। জ্বর,পেটে ইনফেকশন, শরীরে ভাইরাল বাসা বেঁধেছে। ডাক্তার বলেছে চুপচাপ শুয়ে থাকতে। ক্লান্তিতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম কে জানে। হঠাৎ আমার ঘুম ভাঙলো ওর ডাকে…”কিগো ঘুমোচ্ছো?

“আমি আড়ামোড়া ভেঙে বলে উঠলাম, “কেন বিরক্ত করছিস বলতো..? শরীরটা খারাপ, একটু কোথায় ঘুমোবো…তা নয়, আমার ঘুমটাই চটকে দিলি। কেন এসেছিস কেন?…কি চাই কি..?” একটু বিরক্ত হয়েই কথাগুলো বললাম। আবার পরক্ষণেই মনটা খারাপ হয়ে গেল ওর জন্যে..

একটা ৬/৭ বছরের মা-মরা ছেলে গুড্ডু..বাপটা আবার বিয়ে করে নতুন সংসার নিয়ে থাকে।সেখানে গুড্ডু বাড়তি। গুড্ডুর ভালো নাম আনিরুল। সে থাকে আমাদের এলাকার একটা ঝুপড়িতে,তার ঠাকুমা আর দাদুর কাছে। ঠিকে ঝিয়ের কাজ করে কোনোরকমে নুন আনতে পান্তা ফুরোয় তাদের ছিটেবেড়ার সংসারে।

সেই গুড্ডু আমার ঝাঁঝানি শুনে একটু যেন চুপসে গেল। গুড্ডু তার বাম হাত দিয়ে কি একটা কাগজে মোড়া জিনিস তার বুকের কাছে ধরে আছে। আর তার ডানহাত আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো, “আমাকে দুটো টাকা দেবে…দাওনা গো…!!”

কোনোদিনই চায়না।আজ চাইছে।কিন্তু কেন..?বললাম.. “কি করবি টাকা নিয়ে..? ” সে একটু চুপ করে তারপর বলে উঠলো “দিদিভাই, ভোম্বল দাদা, ভুতুভাই এরা সবাই আমাকে ঠাকুরের ছবি আর পয়সা দিয়েছে, পরশু ঠাকুর পুজো তো, তাই ঠাকুরের ছবিও দিয়েছে। কিন্তু দোকানে মালার দাম কালকে বা পরশু প্রায় ১২ টাকা হবে…তাই তোমার কাছে দুটো টাকা চাইছি। আমি বললাম, “আগে দেখা তোর ঠাকুরের ছবিটা। তবে টাকা দেব..”। সে উৎসাহিত হয়ে বললো, “দেখালে ঠিক” দেবেতো??” আমি বললাম,
“হ্যাঁরে, দেব।আগে দেখা তোর ঠাকুরের ছবিটা।”…..

অতি যত্ন করে গুড্ডু তার ছোট্ট বুকের মধ্যে আঁকড়ে ধরেছিল যে জিনিসটা সেটি সে আস্তে আস্তে কাগজ খুলে দেখাল….!! বলল..” এই দেখো আমার ঠাকুরের ছবি। দিদিভাই দিয়ে বলেছে এই ঠাকুর আমাদের সক্কলের…,দাও না গো এবার দুটো টাকা, ঠাকুরের মালা কিনবো পরশু…”।

এ কি দেখছি আমি??!! মা-মরা বাপ হারা অনাথ এতিম গুড্ডুর বুকেতে আটকে থাকা এই ঠাকুরের তো কোনো মন্দির নেই, নেই মসজিদ, নেই গীর্জা, নেই কোনও জাতপাত ধর্মাধর্মের বিচার বিভেদ, এই ঠাকুর আমাদের সকলের একমাত্র পথ ও পাথেয়। যিনি সেই কবে বলে গেছেন…”আপন হতে বাহির হয়ে বাইরে দাঁড়া,বুকের মাঝে বিশ্বলোকের পাবি সাড়া… “।

আমার অসুস্থ শরীরে দুচোখ ছাপানো লুকিয়ে থাকা কান্না।গুড্ডুকে বললাম,” শোন, কাল বা পরশু সকালে চলে আসবি,আমি তোর ঠাকুর পুজোর মালা কেনার পুরো টাকাটাই দিয়ে দেব।”…হঠাৎ গুড্ডু বলে উঠলো.. “তোমার চোখে জল কেন…?” আমি বললাম, “না রে না…জ্বর হয়েছে তো,তাই চোখ দুটো ছলছল করছে।”

গুড্ডু চলে গেল।তার বুকেতে অতি আদরে তার ঠাকুরের ছবিটা নিয়ে।

রেখে গেল এক পরম সত্য…

আজ ২০ শে শ্রাবণ… কাল বাদ পরশু ২২ শে শ্রাবণ…রবীন্দ্রনাথের মহাপ্রস্থানের দিন। গুড্ডু র ঠাকুর পুজোর দিন।

একটি সত্য ঘটনা অবলম্বনে

আরও খবর

মন্তব্য করুন

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.