পঙ্কজ চট্টোপাধ্যায়
১৯২৭ সালের ২৬শে আগস্ট কলকাতার ১ নম্বর গার্স্টিন প্লেসে শুরু হয়েছিল ভারতের দ্বিতীয় বেতার কেন্দ্র। প্রথমদিকে খুব অল্পসংখ্যক মানুষ রেডিও শুনতে পারতেন, সেটিও আবার টাকার বিনিময়ে। ধীরে ধীরে সম্প্রচার ব্যবস্থার উন্নতি হতে থাকে। ১৯২৯–৩০ সালে হীরেন বসুর প্রযোজনায় ভোর চারটের সময় সম্প্রচারিত হয়েছিল পাখিদের কলকাকলিতে ভরা একটি অনুষ্ঠান — প্রভাতী। এর গ্রন্থনা করেছিলেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র, আর গান গেয়েছিলেন আভা দেবী।
১৯৩২ সালে বাংলার বাসন্তী পুজো ও অন্নপূর্ণা পুজোর সন্ধিক্ষণে সম্প্রচারিত হয় বাণীকুমার (বৈদ্যনাথ ভট্টাচার্য)-এর রচনা বসন্তেশ্বরী। এতে গ্রন্থনায় ছিলেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র, সঙ্গীত পরিচালনায় রাইচাঁদ বড়াল, পণ্ডিত হরিশ্চন্দ্র বালী ও পঙ্কজ কুমার মল্লিক। এই অনুষ্ঠানই বাঙালির মনে সাড়া জাগায়। এরপর পরিকল্পনা করা হয় শারদোৎসবে অনুরূপ আয়োজনের। নৃপেন্দ্র মজুমদারের তত্ত্বাবধানে, অশোক নাথ শাস্ত্রীর সহায়তায় এবং বাণীকুমারের কলমে তৈরি হয় মহিষাসুর বধ। গানে সুর দেন পঙ্কজ কুমার মল্লিক, রাইচাঁদ বড়াল, হরিশ্চন্দ্র বালী ও ওস্তাদ সাগীরুদ্দিন খাঁ। ১৯৩২ সালের মহাষষ্ঠীর ভোরে সম্প্রচারিত হয় অনুষ্ঠানটি।
১৯৩২ থেকে ১৯৩৬ পর্যন্ত কখনো মহালয়ার দিনে, কখনো মহাষষ্ঠীতে এই প্রভাতী অনুষ্ঠান সম্প্রচারিত হত মহিষাসুর বধ নামে। ১৯৩৭ সাল থেকে এটি স্থায়ীভাবে মহালয়ার ভোরে মহিষাসুরমর্দিনী নামে সম্প্রচারিত হতে থাকে।
প্রেমাঙ্কুর আতর্থীর লেখা থেকে জানা যায়, বৈদ্যনাথ ভট্টাচার্য, পঙ্কজ কুমার মল্লিক, বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র, হীরেন বসু, অশোক শাস্ত্রী, রাইচাঁদ বড়াল প্রমুখের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় গড়ে ওঠে এই অনুষ্ঠান। ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত শিল্পীরা লাইভ সম্প্রচারে অংশ নিতেন। এরপর অনুষ্ঠানটি রেকর্ড করা হয়।
এই গীতিআলেখ্যে রয়েছে ১৯টি গান, যেখানে সুর দিয়েছেন পঙ্কজ মল্লিক, হরিশ্চন্দ্র বালী, রাইচাঁদ বড়াল, সাগীরুদ্দিন খাঁ প্রমুখ। শিল্পীদের তালিকায় আছেন জগন্ময় মিত্র, পান্নালাল ভট্টাচার্য, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, আরতি মুখোপাধ্যায়, উৎপলা সেন, মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়-সহ বহু গুণী। বাদ্যযন্ত্রে অংশ নেন খুশি মহম্মদ, তারকনাথ দে, সুরেন পাল, ভি. বালসারা প্রমুখ।
এই অনুষ্ঠানে শোনা যায় শ্রীশ্রী চণ্ডী, মার্কণ্ডেয় পুরাণ ও দুর্গা সপ্তশতী থেকে নেওয়া স্তোত্রপাঠ। একমেবাদ্বিতীয়ম ভঙ্গিতে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রই হয়ে ওঠেন এই পাঠের প্রতীক।
শারদীয়ার আগমনী গান, স্তোত্র, ধ্রুপদী সঙ্গীত ও পৌরাণিক কাহিনির মেলবন্ধনে মহিষাসুরমর্দিনী আজ বাঙালির কাছে এক অনন্য ঐতিহ্য। ধর্ম-বর্ণ-লিঙ্গ নির্বিশেষে মহালয়ার প্রভাত মানেই এই অনুষ্ঠানের প্রতি আবেগ ও আকর্ষণ। তাই মহালয়ার ভোরের এই অনুষ্ঠান নিজেই এক ইতিহাস, এক সার্বজনীন মিলনমেলা।
আজ এই পুণ্যদিনে সকলকে জানাই শারদীয়ার আন্তরিক শুভেচ্ছা।