পঙ্কজ চট্টোপাধ্যায়
১৮৮৩ সাল। অক্টোবর মাসের কোনও এক রবিবার — প্রায় ১৪২/১৪৩ বছর আগের এক অনির্বচনীয় মুহূর্ত, যা আজও প্রণম্য।
বিষ্ণু মন্দিরের বারান্দায় ২০ বছরের সদ্য যুবক নরেন্দ্রনাথের সঙ্গে ভগবৎ প্রসঙ্গে আলোচনায় মগ্ন ছিলেন শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব। কথার মাঝেই যথারীতি ভাবসমাধিতে নিমগ্ন হয়ে পড়লেন ঠাকুর।
নরেন তন্ময় হয়ে শুনছিলেন ঠাকুরের মুখনিঃসৃত দেববাণী। হঠাৎ তাঁর মনে পড়ল বহুদিনের একটি ইচ্ছার কথা — ঠাকুরের একটি ছবি তোলার।
এর আগেও নরেন ঠাকুরকে বহুবার অনুরোধ করেছিলেন, কিন্তু ঠাকুর কখনও রাজি হননি। বিষয়টি নিয়ে নরেন তাঁর সঙ্গীদের সঙ্গেও আলোচনা করেছিলেন। শেষ পর্যন্ত ঠাকুরের অন্যতম গৃহীভক্ত ভবনাথ চট্টোপাধ্যায় একটি উপায় বাতলালেন। তখনই নরেন ও ভবনাথ পরিকল্পনা করেন কীভাবে ঠাকুরের ছবি তোলা যায়।
ভবনাথবাবুর পরিচিত ছিলেন তখনকার কলকাতার অন্যতম খ্যাতনামা ফটোগ্রাফার, বার্ন অ্যান্ড শেফার্ড সংস্থার “ফটোবাবু” অবিনাশচন্দ্র দাঁ। আগেই তাঁকে বিষয়টি জানানো হয়েছিল। তিনি প্রায় প্রতি রবিবারই সময় পেলে ঠাকুরের শ্রীবচন শুনতে মন্দিরে আসতেন। সেই রবিবারও পরিকল্পনামতো তিনি উপস্থিত ছিলেন।
সেদিন বিষ্ণু মন্দিরের সেই বারান্দায় ঘটে গেল এক অনন্যসাধারণ, ঐতিহাসিক মুহূর্ত। ভাবসমাধিতে নিমগ্ন শ্রীরামকৃষ্ণ — চোখ দুটি অর্ধউন্মীলিত, যেন দেবাদিদেব মহাদেবের রূপ। ঠিক সেই মুহূর্তেই ক্যামেরার শাটার টিপলেন অবিনাশবাবু। কিন্তু সেই পবিত্র মুহূর্তের গুরুত্বে ও উদ্বেগে তাঁর হাত কাঁপছিল। ফটো তোলার পর হঠাৎ নেগেটিভের কাচটি হাত থেকে পড়ে ভেঙে যায় এক কোণে। আতঙ্কিত হয়ে অবিনাশবাবু সেটি গোল করে কেটে ফেলেন। সেই কারণেই আজও ঠাকুরের ধ্যানমগ্ন ছবিটির পেছনে একটি গোলাকার হালকা ছায়া দেখা যায়।
প্রায় তিন সপ্তাহ পরে অবিনাশবাবুর কাছ থেকে ভবনাথবাবু ছবিটি সংগ্রহ করে কাশীপুরে ঠাকুরের হাতে তুলে দেন। ছবিটি দেখে ঠাকুর সহাস্যে মা সারদাকে উদ্দেশ করে বলেন—
“ওগো, দেখো! এরপর ঘরে ঘরে এই ছবি পূজো পাবে, পূজো হবে। মাইরি বলছি, দেখে নিও…”
এরপর ঠাকুর আবার ভাবসমাধিতে নিমগ্ন হন।
এ যেন এক প্রণম্য অজানা ইতিহাস — সত্যিই আজ সারা বিশ্বে, ঘরে ঘরে, সেই ধ্যানমগ্ন শ্রীরামকৃষ্ণের ছবিটি পূজিত হচ্ছে, তাঁর কাছে প্রার্থনা করা হয়।
জয় ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব।
জয় শ্রীমা সারদামণি জগজ্জননী।
জয় স্বামী বিবেকানন্দ মহারাজ।