পঙ্কজ চট্টোপাধ্যায়
কিরণময় সেন — নামটাই বোধহয় শুনিনি আমরা।জন্ম-১৯১৫ সালে,অবিভক্ত বাংলার চট্টগ্রামে (এখন বাংলাদেশের) পটিয়া থানার হাবিলাসদ্বীপে। তিনি যখন স্কুলের ছাত্র–তখন থেকেই পরাধীন ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনের বিপ্লবীদের সংশ্রবে এসেছিলেন তিনি।
তখন, ব্রিটিশ রাজশক্তি চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠন-এর নায়ক, চট্টগ্রামের ইউরোপীয়ান ক্লাব ধ্বংস করার নায়ক, জালালাবাদ-এর যুদ্ধের অসমসাহসী নায়ক–মাস্টারদা সূর্য সেন-কে জীবিত অথবা মৃত অবস্থায় ধরার জন্য উঠেপড়ে লেগেছিল। ব্রিটিশদের রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছিলেন এই দেশপ্রেমিক মাস্টারদা সূর্য সেন। কিন্তু কিছুতেই ধরা যায়নি তাঁকে।তাই ব্রিটিশ সরকার সূর্য সেন-কে ধরার জন্যে তখনকার দিনে ১০ হাজার টাকা যে ধরিয়ে দেবে,তাকে দেওয়া হবে বলে ঘোষণা করেছিল।
সূর্য সেন তখন অন্যান্য বিপ্লবীদের সাথে আত্মগোপন করে রয়েছেন চট্টগ্রাম জেলার কৈরলা গ্রামে শ্রীমতী ক্ষিরোদপ্রভা বিশ্বাসের বাড়িতে। যদিও তাঁরা দিনের বেলায় বাইরে বেরতেন না,রাতে বাড়ির ছাদে বেরতেন। প্রতিবেশীরা সেই বাড়িতে কেউ এলে,বিপ্লবীরা কেউ তাদের সাথে দেখাও করতেন না। তবু তারই মধ্যে কেউ কেউ কৌতূহলী হয়ে উঠেছিল। তাদের মধ্যে একজন হল সূর্য সেনের এক দুরসম্পর্কের আত্মীয় নেত্র সেন।কয়েকটি বাড়ির পরেই থাকে,একই গ্রামে।
যাইহোক, সেদিন ছিল ১৯৩৩ সালের ১৬ই ফেব্রুয়ারী, শীতের রাত–ক্ষীরোদপ্রভা দেবীর বাড়িতেই এক অতি গোপন আলোচনায় মগ্ন ছিলেন বিপ্লবী সূর্য সেন,কল্পনা দত্ত(পরে কল্পনা যোশী),শান্তি চক্রবর্তী, মনি দত্ত,ব্রজেন সেন এবং সুশীল দাশগুপ্ত।
বিপ্লবী ব্রজেন সেনের দাদা ছিল ঐ নেত্র সেন। নেশাগ্রস্ত মানুষ, আর টাকার ভীষণ লোভী।টাকার জন্যে সব কিছু করতে পারে। সেই নেত্র সেন আগেই স্থানীয় পুলিশের কাছে সূর্য সেনের গোপন আস্তানার খবর টাকার লোভে বিশ্বাসঘাতকতা করে পৌঁছে দিয়েছিল। যথারীতি ব্রিটিশ পুলিশের বিরাট বাহিনী সেই ১৬ ই ফেব্রুয়ারীর রাতে ক্ষীরোদপ্রভা দেবীর বাড়ি ঘিরে ফেলে,এবং সেখান থেকে মাস্টারদা সূর্য সেন, এবং ব্রজেন সেন-কে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। বাকিরা পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়।
গ্রেপ্তারের পর সূর্য সেনের ওপরে শুরু হয় ব্রিটিশ পুলিশের অকথ্য অত্যাচার,অমানুষিক প্রহার,ইত্যাদি,ইত্যাদি।
বিচারের নামে চলে প্রহসন,আর জেলের মধ্যে চলে সূর্য সেনের ওপরে নানা ধরনের অত্যাচার।
নেত্র সেনের এক ভাই এই কিরণ সেন তখন অষ্টম কি নবম শ্রেনীর ছাত্র। কিরণের প্রাণের দেবতা ছিলেন মাস্টারদা। ঈশ্বরের মতো ভালবাসতেন,শ্রদ্ধা করতেন কিরণময় এই
সূর্য সেন-কে। মাস্টারদা তো দেশের জন্য,দেশের মানুষের স্বাধীনতার জন্য নিজের ঘরবাড়ি,সদ্য বিবাহিতা স্ত্রী,সংসার,ছেড়ে দেশের মানুষের জন্যই নিজেকে উৎসর্গ করেছেন মুক্তির মন্দির সোপানতলে। এহেন মানুষ-এর সাথে,দেশের সাথে,জাতির সাথে বিশ্বাসঘাতকতা? এটা কখনোই মানা যায়না। শুধু কিরণ নয়,নেত্র সেনের গ্রাম্যঘরের স্ত্রীও নেত্র সেনের এই জঘন্য,কৃতঘ্ন কাজের জন্যে স্বামীকে মনে মনে ঘৃণা করতেন, ক্ষমাও করতে পারেননি।
কিরণের এবং বিপ্লবীদের চরম আক্রোশ গিয়ে পড়ল নেত্র সেনের ওপরে। তুষের আগুনের মতো জ্বলতে থাকে বদলা নেবার প্রতিশোধের আগুন।যতই দাদা হোক,আসলে সে মীরজাফর, সে বিভীষণ, সে ক্ষমার অযোগ্য এক দেশদ্রোহী,জাতির কলঙ্ক। এই শয়তান বিশ্বাসঘাতক-কে শাস্তি দিতেই হবে,একে কোনও মাফ নেই।এই দেশের মাটিতে এর কোনও ঠাঁই নেই।
নেত্র সেন ইতিমধ্যে পুলিশের কাছ থেকে সূর্য সেনকে ধরিয়ে দিয়ে বেশ মোটা টাকা পেয়ে বেশ বহাল তবিয়তে রয়েছে। আর অপরদিকে দেশমাতৃকার নয়নেরমণি মাস্টারদা-র ওপরে কারান্তরালে চলছে ব্রিটিশ পুলিশের,জেলের,
অকথ্য অমানুষিক বিভৎস রকমের অত্যাচার। ব্রিটিশ শাসকের পোষা পুলিশ, প্রশাসনের লোকেরা সূর্য সেনের হাতের,পায়ের নখ সাঁড়াসি দিয়ে উপড়ে দিয়েছে,এলোপাতাড়ি লাথি,কিল, চড়,ঘুষি চলছে।মাথার চুলগুলো টেনে টেনে ছিঁড়ে দেওয়া,চোখের ভেতরে সরু শলাকা ঢুকিয়ে রক্তাক্ত করে দেওয়া,হাতুড়ি দিয়ে মুখের দাঁতগুলো ভেঙে দেওয়া,ইত্যাদি ইত্যাদি, বর্ণনার অতীত সেইসব অত্যাচার। তখন সূর্য সেন প্রায় মৃত অবস্থায়, শুধু প্রাণটুকু ধুকধুক করছে। এমন সময়ে সূর্য সেনের ফাঁসীর দিন ঘোষণা করা হোল– ১৯৩৪ সালের ১২ই জানুয়ারী।
সারা বাংলা ক্ষোভে ফেটে পড়লো।চারিদিকে আন্দোলন আন্দোলন আর আন্দোলন। সকলের মনেই বদলা নেবার আকাঙ্খা– শয়তান বিশ্বাসঘাতক নেত্র সেন-কে চরম শাস্তি দিতেই হবে।কোনও ছাড় নেই তার।আর সেটা সূর্য সেনের ফাঁসীর আগেই বদলা নিতে হবে।
১৯৩৪ সালের ৯ই জানুয়ারী। শীতকাল -প্রচন্ড ঠান্ডার রাত। নিজের বাড়িতে রাতের খাবার খেতে বসেছে খোশমেজাজে নেত্র সেন। গরম গরম ভাত খাবে সে।সামনে তরিতরকারি সহ গরম ভাতের থালা। সামনে বসে আছেন তার স্ত্রী। যদিও স্ত্রী তার স্বামী নেত্র সেনকে মনেপ্রাণে চরম ঘৃণা করেন,কিন্তু অনন্যোপায় হয়ে তার সাথে থাকতে হয়,কারন কোনও অন্য উপায় তো নেই সেই গ্রাম্যমহিলার।
হঠাৎ দরজায় কড়া নাড়া। নেত্রর নির্দেশে নেত্রর স্ত্রী উঠে দরজা খুলে দিতেই তড়িৎগতিতে ঘরে ঢুকে পড়লো কিরণ…,তার হাতে একটা বিশাল রাম-দা– আগেই কিরণময় নিজে শপথ নিয়েছে বদলা নেবার।তার মনে পড়ছে তার প্রাণের দেবতা সূর্য সেনের ওপরে অকথ্য অত্যাচারের কথা,আর সামনে এখন রয়েছে সেই বিশ্বাসঘাতক নেত্র সেন,যার জন্যে আজ মাস্টারদা সূর্য সেনের ফাঁসী হতে চলেছে। কিরণের হাতের বিশাল রাম-দা এক কোপে নেত্রর শরীর থেকে নেত্র-র মাথাটা আলাদা করে দিল।ফিনকি দিয়ে রক্তের স্রোত গড়িয়ে পড়ছে। নেত্রর স্ত্রীর চোখের সামনেই ঘটে গেল ঘটনাটি।তিনি নিস্পন্দ, নির্বাক,স্থানুবৎ দাঁড়িয়ে রইলেন সেখানে। কিরণের সাথে সেদিন আরেকজন বিপ্লবী ছিলেন,নাম রবীন্দ্র(খোকা) নন্দী।
কিরণ বদলা নেওয়ার পরেই নেত্র-র স্ত্রীর পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে বলেছিলেন –“বৌঠান,এ ছাড়া অন্য কোনও উপায় ছিল না। আমায় ক্ষমা কোরো।”
রাতের অন্ধকারে মিলিয়ে গেল কিরণ,আর রবীন্দ্র।
পরে ব্রিটিশের পুলিশ নেত্রর স্ত্রীকে অনেক জেরা করে জানতে চেয়েছিল, যে তিনি ঘাতকদের চিনতে পেরেছিলেন কি’না। এমন কি পরে যখন সন্দেহের বশে কিরণ গ্রেপ্তার হয়েছিলেন, তাকে সামনে রেখেও জিজ্ঞাসাবাদ করেছিল পুলিশ,কিন্তু,একই জবাব দিয়েছিলেন সেই মহীয়সী নারী — “না,সেই রাতে যারা এসেছিল,তাদের চিনতে পারিনি,কারণ সবার মুখ ঢাকা ছিল…”।
প্রণাম সেই মহীয়সী নারীকে। তার কথা আমরা জানিই না। আর কিরণ এরপর চলে যায় রেঙ্গুনে এক দাদার আশ্রয়ে।সেখানেও তিনি দেশের স্বাধীনতার বৈপ্লবিক কাজে যুক্ত হয়েছিলেন, এবং ৫বছর রেঙ্গুনের এবং অন্যান্য জেলে বন্দী হিসাবে ছিলেন। তারপর মুক্তি পেয়ে ফিরে আসেন ভারতে। ১৯৪৭ এ স্বাধীনতা আসে।কিন্তু সেই স্বাধীনতা আসে খন্ডিত ভারতবর্ষকে সামনে রেখে। কিরণময় মেনে নিতে পারেন নি এই দেশভাগ। তিনি চলে আসেন এপার বাংলায়। এখানে দামোদর ভ্যালি করপোরেশন সংস্থায় চাকরি করতে শুরু করেন।লোকচক্ষুর আড়ালেই থাকেন সারাজীবন। রাষ্ট্রের সমস্ত সম্মান প্রত্যাখ্যান করেন ঘৃণায়।
তারপর ১৯৯৮ সালের ১০ই অক্টোবর কলকাতায় প্রয়াত হন এই বিপ্লবী কিরণময় সেন।
দুঃখের বিষয়, ভারতবর্ষ তথা আমাদের বাংলা এই বিপ্লবী কিরণময় সেন-কে মনেই রাখেনি। জানেও না তার নাম–তার বলিষ্ঠ বৈপ্লবিক অবদানের কাহিনী।
আগস্ট মাস স্বাধীনতার মাস– বিপ্লবী কিরণময় সেনের কাছে আমরা ক্ষমাপ্রার্থী।