প্রথম পাতা প্রবন্ধ কত অজানাই রয়ে গেছে ইতিহাস

কত অজানাই রয়ে গেছে ইতিহাস

233 views
A+A-
Reset

পঙ্কজ চট্টোপাধ্যায়

জানি না,কোন অদৃশ্য কারনে আমাদের দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসের সত্যতা সঠিকভাবে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে আমাদের প্রজন্মের পর প্রজন্মের কাছে অনালোকিত, অনালোচিত রয়ে গেল। সেই কত অজানাই যদিও আমাদের দেশের ইতিহাসের নিখাদ আসল সত্যতা।

৮ ডিসেম্বর, ১৯৩০ সাল। পরাধীন ভারতবর্ষের শহর কলকাতা। ব্যস্ত দিনের প্রায় দ্বিপ্রহর। শহরের প্রাণকেন্দ্রে রাইটার্স বিল্ডিং। তিনজন তরতাজা তরুন আদ্যোপান্ত সাহেবী পোশাক পরিহিত হয়ে প্রবেশ করলেন রাইটার্স -এ। গেটে থাকা রক্ষীরা কেউই বুঝতে পারল না,কে বা কারা এরা? সেই তিনজন দোতলায় চলে গেলেন। তারপর তারা দাঁড়িয়ে পড়লেন সেই সময়ের অত্যাচারী ইংরেজ পুলিশের ইন্সপেক্টর জেনারেল সিম্পসন সাহেবের ঘরের সামনে।দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকেই সাহেব কিছু বুঝে ওঠার আগেই ‘দ্রাম্ দ্রাম্ দ্রাম্’…পরপর তিনটে গুলি।সাহেবের ততক্ষণে ভবলীলা শেষ। দিন-দুপুরে গুলির আওয়াজ শুনে চারিদিক থেকে রক্ষীরা পড়িমড়ি করে ছুটে এলো। নিমেষের মধ্যে পুলিশে পুলিশে ছয়লাপ।এসে গেল পুলিশ কমিশনার চার্লস টেগার্ট। চারিদিক থমথমে।

শুরু হোল রাইটার্স বিল্ডিং-এর বারান্দায় রক্তক্ষয়ী লড়াই। একদিকে ওই তিনজন দেশপ্রেমিক বিপ্লবী তরুণ,আর অন্যদিকে ব্রিটিশ পুলিশের বিরাট গোর্খা বাহিনী। যাদের নাটের গুরু টেগার্ট।

কিছুক্ষণ লড়াই চলার পরে তিন বিপ্লবী একটা ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলেন।তারা ব্রিটিশ পুলিশের হাতে ধরা দেবেন না। তাই সেই বিপ্লবীদের একজন নাম বাদল গুপ্ত,তিনি মুখে পুরে দিলেন ভয়ংকর বিষ– পটাশিয়াম সায়ানাডের ক্যাপসুল। আর সঙ্গে সঙ্গে তিনি শহীদ হয়েছিলেন। বাকী দুজন নিজেদের মাথায় চালালেন নিজেদের রিভলবার থেকে গুলি। মারাত্মকভাবে আহত হয়ে, রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে রইলেন মেঝেতে। সেই দুজনের একজন বিনয় কৃষ্ণ বসু– হাসপাতালে ৫দিন পরে মারা গেলেন–শহীদ হলেন।আর আরেকজন দীনেশ গুপ্ত প্রাণে বাঁচলেও,হলেন বন্দীএবং বিচারের নামে প্রহসন শেষে হোল দীনেশের ফাঁসী।আর এই বিচারের প্রহসন চালালো ব্রিটিশ বিচারক মিঃ গার্লিক। দীনেশের ফাঁসী হোল ৭ জুলাই, ১৯৩১ সাল।

ইতিহাস রচিত হোল “বিনয়-বাদল-দীনেশ” -এর অলিন্দ যুদ্ধের নামে। সেদিন সারা বাংলা তথা সারা দেশের বিভিন্ন বয়সের মানুষ আগ্নেয়গিরির মতো এক চাপা ক্ষোভে ,আক্রোশে ফেটে পড়বার অপেক্ষায়,নারী পুরুষ নির্বিশেষে।

এই ঘটনার ঠিক ২০ দিন পরে…

দিনটা ছিল ২৭ শে জুলাই, ১৯৩১ সাল। সকাল ১০ টা। একটা কালো অস্টিন গাড়ি এসে ঢুকলো কলকাতার আলিপুর কোর্ট-এর চত্বরে। গাড়ির সামনে বসা বন্দুকধারী দেহরক্ষী গাড়ি থেকে নেমে খুলে দিল গাড়ির পেছনের দরজা। ধীরে ধীরে নেমে এলো সেই কুখ্যাত বিচারপতি মিঃ গার্লিক। বেশ খোশ মেজাজে গুনগুন করতে করতে এগিয়ে চলল আদালতের সিঁড়ির দিকে। দু-তিন ধাপ উঠেছে গার্লিক, –অমনি তৎক্ষনাৎ সিঁড়ির ওপরের থামের আড়াল থেকে বেরিয়ে এলো একজন রোগা-সোগা পাতলা শরীরের কিশোর। আচমকাই বিস্ময়ে গার্লিক দেখল,তার দিকে তাক্ করে রয়েছে সেই কিশোরের হাতে ধরা রিভলবার। গার্লিক ভয়ে,প্রাণের দায়ে কিছু বলার আগেই কিশোরের হাতের রিভলবারের পাঁচটা গুলি ছুটে এসে গার্লিককে এফোঁড়-ওফোঁড় করে ভবসাগর পার করিয়ে দিল। শয়তান ঘৃন্য বিচারকের জন্য নির্দিষ্ট করা শেষ বিচার সম্পন্ন হোল। ততক্ষণে অবশ্য বিচারপতির দেহরক্ষীও গুলি চালিয়েছে সেই কিশোরকে লক্ষ্য করে।আহত,রক্তাক্ত অবস্থাতেই সেই কিশোর মুখে “বন্দেমাতরম” ধ্বনি দিতে দিতে তার পকেটে থাকা পটাশিয়াম সায়ানাইড মুখে পুরে দিয়ে ঢলে পড়েছিল মৃত্যুর কোলে,–সেই সিঁড়ির ওপরেই আছড়ে পড়েছিল তার শরীর।

কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘটনাস্থলে এসে হাজির হয়েছিল সেই পুলিশ কমিশনার টেগার্ট।সঙ্গে কলকাতা পুলিশের বাঘা বাঘা সব গোয়েন্দারা।চলল তল্লাশী –পাওয়া গেল সেই কিশোরের পকেটে রাখা একটা নোটবুক। তার প্রথম পাতায় স্বামী বিবেকানন্দের ছবি,দ্বিতীয়,তৃতীয় পাতায় রবীন্দ্রনাথ, কাজী নজরুল ইসলাম-এর লেখা কবিতা,গান।আর শেষ পাতায় একটা রায়,তাতে লেখা–” Get destroyed, get the award for hanging our Dinesh Gupta….”, তার নীচে স্বাক্ষর ” বিমল দাশগুপ্ত “।

কিন্তু কে এই কিশোর? কে এই বিমল দাশগুপ্ত? হ্যাঁ, এক রোমহষর্ক কাহিনী লুকিয়ে আছে এই ঘটনার আড়ালে।

বিমল দাশগুপ্ত –মেদিনীপুরের অত্যাচারী জেলাশাসক মিঃ প্যাডি-কে হত্যা করার অভিযোগে যাকে ব্রিটিশ পুলিশের লোক,গোয়েন্দা বাহিনী হন্যে হোয়ে খুঁজে চলেছে তখনও। কিন্তু তাকে খুঁজেই পাওয়া যায়নি।কোথায় যেন কপ্পুরের মতো উবে গেছে। এবার কিশোরের পকেটের ঐ লেখা দেখে পুলিশ হাঁফ ছেড়ে ভাবলো,যাক বিমল দাশগুপ্তকে পাওয়া গেল,সে আর বেঁচে নাই। উফ্, কি দামাল দস্যি ছেলে রে বাবা,পরপর অত্যাচারী ইংরেজ খুন,একার হাতে???

কিন্তু না- আসল সত্য হোল,–সেদিনের গার্লিক-কে হত্যা করে যে কিশোর নিজে শহীদ হয়েছিল,সে বিমল দাশগুপ্ত নয়,–সে হোল ২৪ পরগনা জেলার জয়নগর-মজিলপুরের কানাইলাল ভট্টাচার্য। কানাই স্কুলের ছাত্রাবস্থায় বিপ্লবীদের সংস্পর্শে আসেন।যুক্ত হন নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স-এ। শয়তান গার্লিক-কে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেবার দায়িত্ব সেই নিজে নিয়ে নেয়। আর ইচ্ছে করেই পকেটে বিমলের নাম লেখা কাগজ রেখে দিয়েছিল সে,তার কারন এর ফলে সে নিজে শহীদ হবেই, এবং পুলিশ ভাববে বিমল শহীদ হয়েছে,তাই বিমলকে আর পুলিশ খুঁজবে না। বিমল আরও বিপ্লবের কাজ করতে পারবে দেশমাতৃকার জন্যে। থাকলোই বা কানাই-এর নামটা লোকচক্ষুর আড়ালে,তাতে কোনও দুঃখ নেই।

ভাবুন,ভাবুন, আজকের এই স্বাধীন দেশের মানুষ। কি চরম স্বার্থহীন আত্মবলিদান!! নিজেকে সবার আড়ালে রেখে জীবন দিতেও রাজী সেইসব মহান দেশপ্রেমিকরা। “জীবন মৃত্যু পায়ের ভৃত্য,চিত্ত ভাবনাহীন..”।

সম্ভবত স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে কানাইলাল-ই একমাত্র বিপ্লবী শহীদ দেশপ্রেমিক –যিনি এক অত্যাচারী ইংরেজ শাসককে হত্যা করার বৈপ্লবিক কৃতিত্বের চেয়েও এক বিপ্লবী সহযোদ্ধার জীবনকে অগ্রাধিকার দিয়েছিলেন,নিজের নাম আড়ালে রেখে– নিজের জীবন দিয়ে।

এই কানাইলাল ১৯০৯ সালের ২২ আগস্ট জন্মগ্রহণ করেন।বাবা ছিলেন নগেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য, আর বীর-প্রসবিনী মায়ের নাম ছিল কাত্যায়নী দেবী।

এর পরেও এক আশ্চর্য কাহিনী হোল,যে এই পরিকল্পনার কথা জানতেন মা কাত্যায়নী দেবী। তাই পরে ব্রিটিশ পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদের জবাবে বুকের মধ্যে নাড়ীছেঁড়া সন্তানের মৃত্যুর কষ্ট লুকিয়ে রেখেও সেদিন মা কাত্যায়নী দেবী কানাইলালের মৃতদেহ শনাক্তকরণ-এর সময়ে বলেছিলেন,নিজের ছেলের পরিচয় গোপন করে–” না,এ আমার কানু নয়…”। তখন সেই মায়ের বুকের মধ্যে যে উপর্যুপরি পড়েছিল বজ্রপাতের চেয়েও কঠিন আঘাতের পর আঘাত।মুছে নিয়েছিলেন মায়ের সমস্ত কান্না সবার চোখের আড়ালে,অন্তরালে। তবু তিনি এক ইতিহাস রচনা করেছিলেন আর এক সন্তানসম বিমল দাশগুপ্তকে বাঁচানোর জন্যে।

ওগো মা আমার,তোমার দুটি পায়ের পাতায় রেখে যাই ভালোবাসায়,বিনম্রতায়, অপরিশোধ্য আজন্ম ঋণের কৃতজ্ঞতায় আমার চুম্বিত প্রণাম।
এই মায়েদের কথা আমাদের দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসের পাতায় লেখা হয়নি।হায়রে ভারতবর্ষ, হায়রে আমার বাংলা।
মনেই রাখেনি কানাইলাল-কে। কি অকৃতজ্ঞ আমরা,ভাবলেও অবাক হতে হয়।

প্রশ্ন করতে ইচ্ছে হয় নিজেদের,দেশের স্বাধীনতার পরের এবং আজকের নেতা-নেত্রীদের–“বলুন তো,সত্যিই আমরা আপনারা মানুষ তো?”

ইতিহাস কিন্তু মিথ্যার ওপরে কোনওদিন স্থায়ী হয় না।ক্ষমা করে না মিথ্যাচারকে।

মন্তব্য করুন

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.