প্রথম পাতা খবর বিহারের এনডিএ-র জয় তৃণমূলের উদ্বেগের কারণ হতে পারে?

বিহারের এনডিএ-র জয় তৃণমূলের উদ্বেগের কারণ হতে পারে?

54 views
A+A-
Reset

সম্প্রতি বিহার বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি-নেতৃত্বাধীন এনডিএ-র দুর্দান্ত জয় ভারতীয় রাজনীতিতে এক নতুন মাত্রা যোগ করেছে, যার ঢেউ প্রতিবেশী রাজ্য পশ্চিমবঙ্গ পর্যন্ত এসে পৌঁছেছে বলে অনেকে মনে করছেন। তাই এই জয়ের ফলে বাংলার রাজনীতিতে কী প্রভাব পড়তে পারে এবং তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আশঙ্কিত হওয়ার প্রয়োজন আছে কিনা, সেই বিশ্লেষণ জরুরি।

এনডিএ-র জয়ের বার্তা ও বাংলার উপর সম্ভাব্য প্রভাব

বিহারের এই জয় বিজেপির জন্য একটি বিশাল মানসিক এবং রাজনৈতিক উদ্দীপক। এটি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর জনসমর্থন এবং কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের কৌশলগত সাফল্যের উপর আরও একবার সিলমোহর দিয়েছে।

১. আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি: বিহারের ভূমি দখল করার পর, পশ্চিমবঙ্গ বিজেপি নেতাদের আত্মবিশ্বাস এখন তুঙ্গে। রাজ্যের বিরোধী দলনেতা থেকে শুরু করে কেন্দ্রীয় মন্ত্রীরা ইতিমধ্যেই বাংলায় ‘জঙ্গলরাজ’ শেষ করে সরকার গঠনের বার্তা দিতে শুরু করেছেন। এই জয় ২০২৬ সালের পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনের আগে তৃণমূলের বিরুদ্ধে বিজেপির আক্রমণাত্মক প্রচারের টোন সেট করবে। খোদ প্রধানমন্ত্রীও দলের সদরদফতর থেকে বার্তা দিয়ে এবার তাঁর টার্গেট বাংলা। সেখান থেকে ‘জঙ্গলরাজ’ উচ্ছেদ করবে তিনি।

২. মহিলা ভোটারদের গুরুত্ব: বিহারের ফলাফলে একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক উঠে এসেছে – মহিলাদের ভোটদান। নীতীশ কুমারের উন্নয়নমূলক কাজ এবং মহিলাদের জন্য আর্থিক সহায়তার (যেমন, ‘মুখ্যমন্ত্রী মহিলা রোজগার যোজনা’) ফলে মহিলা ভোটারদের একটি বড় অংশ এনডিএ-কে সমর্থন করেছে। পশ্চিমবঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সরকারও ‘লক্ষ্মীর ভান্ডার’, ‘সবুজ সাথী’র মতো নারী-কেন্দ্রিক প্রকল্পগুলির মাধ্যমে মহিলা ভোটারদের একটি শক্তিশালী ভোটব্যাংক তৈরি করেছেন। বিহারের ঘটনা প্রমাণ করে যে, নারী-কেন্দ্রিক জনকল্যাণমূলক প্রকল্পগুলি ভোটের ফলাফলে নির্ণায়ক ভূমিকা নিতে পারে। এই ফ্যাক্টর দিক থেকে দেখলে অনেকটা এগিয়ে আছে তৃণমূল।

৩. সংগঠনের মনোবলের উপর প্রভাব: বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব বিহারের জয়ে যে কৌশল ও সমন্বয় দেখিয়েছে, তা বাংলায় দলীয় কর্মীদের মনে নতুন করে উৎসাহ জাগাবে। অন্যদিকে, তৃণমূল কংগ্রেসকে তাদের ভোটব্যাংক অক্ষত রাখতে আরও সজাগ হতে হবে।

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কি আশঙ্কিত হওয়ার প্রয়োজন আছে?

স্বভাবতই, প্রতিবেশী রাজ্যে বিজেপির বিপুল জয় তৃণমূলের জন্য অস্বস্তিকর। তবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এখনই ‘আশঙ্কিত’ হওয়ার প্রয়োজন আছে কিনা, তা নির্ভর করছে কয়েকটি ভিন্ন রাজনৈতিক সমীকরণের উপর।

১. দুই রাজ্যের রাজনৈতিক ভিন্নতা: তৃণমূল মুখপাত্র কুণাল ঘোষের বক্তব্য অনুযায়ী, বিহার ও বাংলার রাজনৈতিক সমীকরণ এবং মূল ইস্যুগুলি একে অপরের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। বিহারের রাজনীতি জাতি-ভিত্তিক সমীকরণের দ্বারা চালিত, যেখানে বাংলায় দলনেত্রীর ক্যারিশমা, ‘মা, মাটি, মানুষ’-এর আবেগ এবং ‘লক্ষ্মীর ভান্ডার’ সহ বিভিন্ন জনকল্যাণমূলক প্রকল্প গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এখনও পর্যন্ত বাংলার সবচেয়ে জনপ্রিয় মুখ।

২. পিকে-র ব্যর্থতা এবং স্থানীয় নেতৃত্ব: মজার বিষয় হলো, যে ভোটকুশলী প্রশান্ত কিশোর (পিকে) একসময় মমতাকে ২০২১-এর নির্বাচনে সাহায্য করেছিলেন, তিনি এবার বিহারে নিজের দল গঠন করে ব্যর্থ হয়েছেন। অন্যদিকে, তৃণমূলের শক্ত ঘাঁটি এবং স্থানীয় সংগঠনে তার গভীরতা বিজেপির চেয়ে অনেক বেশি। বিজেপি এখনও রাজ্যে একজন গ্রহণযোগ্য মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থী তুলে ধরতে পারেনি, যা তৃণমূলের জন্য একটি বাড়তি সুবিধা।

৩. ‘ইন্ডিয়া’ জোটের দুর্বলতা: বিহারে মহাগঠবন্ধনের পরাজয় (যেখানে বাম দলগুলিরও খারাপ ফল হয়েছে) বিরোধী জোট ‘ইন্ডিয়া’র সামগ্রিক দুর্বলতাকেই ইঙ্গিত করে। তৃণমূল যদিও বিহারে জোটের শরিক ছিল না, তবুও জাতীয় স্তরে বিজেপির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে জোটের এই ব্যর্থতা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ভবিষ্যতে বৃহত্তর রাজনৈতিক কৌশল নিয়ে ভাবতে বাধ্য করতে পারে। তৃণমূলের সাংসদ কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় মন্তব্য করেছেন, বিজেপির বিরুদ্ধে দেশব্যাপী লড়াইয়ের জন্য মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ‘ইন্ডিয়া’ জোটের ‘মুখ’ হওয়া উচিত।

৪. ‘বহিরাগত’ বনাম ‘বাঙালি’ আখ্যান: মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সরকার বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতাদের প্রায়শই ‘বহিরাগত’ (Outsider) হিসেবে চিহ্নিত করে, যার লক্ষ্য হলো বাঙালি আবেগ ও আত্মপরিচয়কে কাজে লাগানো। তৃণমূল দাবি করে যে, বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব বাঙালি সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের প্রতি উদাসীন এবং তারা ‘বাঙালির অধিকার’ কেড়ে নিতে চাইছে। সম্প্রতি বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলিতে বাঙালিদের উপর আক্রমণের বিরুদ্ধে সক্রিয় ভাবে প্রতিবাদ জানাচ্ছে তৃণমূল। যার ফলে বাঙালি আস্মিতাকে কাজে লাগাতে তৃণমূল এই ‘বহিরাগত’ আখ্যানকে আরও জোরদার করতে পারে, যাতে বাংলার ভোটাররা বিজেপির সর্বভারতীয় প্রভাব থেকে নিজেদের দূরে সরিয়ে রাখে।

৫. অর্থনৈতিক বঞ্চনার অভিযোগ: বাঙালি আবেগ শুধুমাত্র ভাষা বা সংস্কৃতির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, এটি রাজ্যের অর্থনৈতিক মর্যাদা এবং কেন্দ্রীয় সরকারের নীতির ওপর নির্ভর করে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রায়শই কেন্দ্রের বিরুদ্ধে রাজ্যের প্রাপ্য অর্থ না দেওয়ার অভিযোগ তোলেন।  আদালতের নির্দেশ সত্ত্বেও ১০০ দিনের কাজের দিচ্ছে না কেন্দ্র, এই ইস্যুকেও আরও জোরাল করতে পারে তৃণমূল।  বিহারের জয়ের পর, রাজ্য বনাম কেন্দ্রের আর্থিক সংঘাত আরও তীব্র হতে পারে, যেখানে তৃণমূল এই সংঘাতকে ‘বাঙালির অধিকারের ওপর আক্রমণ’ হিসেবে তুলে ধরবে।

বিহারের সতর্কবার্তা

বিহারের এনডিএ-র জয় নিঃসন্দেহে বিজেপির জন্য এক বিশাল উদ্দীপক এবং ২০২৬ সালের বঙ্গ নির্বাচনের আগে তাদের আক্রমণাত্মক প্রচারের শক্তি বাড়াবে। তবে এই জয় বাংলায় সরাসরি প্রভাব ফেলবে, এমনটা নিশ্চিতভাবে বলা যায় না। পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি তার নিজস্ব গতিপথ, ইস্যু এবং দলনেত্রীর জনপ্রিয়তার উপর নির্ভর করে।

ভিনরাজ্যে বাঙালিদের উপর আক্রমণের বিরোধিতায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সক্রিয় অবস্থান তাঁকে ২০২৬-এর ভোটে তাঁকে অনেকটাই এগিয়ে রাখবে।  

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্য এই ফল সরাসরি ‘আশঙ্কার’ কারণ না হলেও, এটি নিঃসন্দেহে একটি সতর্কবার্তা। তাঁকে দলীয় সংহতি বজায় রাখতে, কেন্দ্রীয় প্রকল্পগুলির প্রচারের বিপরীতে নিজ সরকারের জনকল্যাণমূলক প্রকল্পগুলির সাফল্যকে আরও শক্তিশালীভাবে তুলে ধরতে এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণভাবে, মহিলা ভোটারদের সমর্থন ধরে রাখতে হবে। বিহারের ফলাফল বাংলায় এনডিএ-কে একটি শক্তিশালী চ্যালেঞ্জার হিসেবে প্রতিষ্ঠা করলেও, বাংলার মসনদ দখলের লড়াই বহুলাংশে নির্ধারিত হবে স্থানীয় ইস্যু, দলীয় কৌশল এবং তৃণমূল নেত্রীর নিজস্ব রাজনৈতিক কৌশেলর ওপর।

আরও খবর

মন্তব্য করুন

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.