প্রথম পাতা প্রবন্ধ বিস্মৃতির অতলে এক সাংবাদিক -‘শরৎচন্দ্র পন্ডিত’, দাদাঠাকুর

বিস্মৃতির অতলে এক সাংবাদিক -‘শরৎচন্দ্র পন্ডিত’, দাদাঠাকুর

191 views
A+A-
Reset

তাঁকে কে নাম দিয়েছিলেন জানি না — কিন্তু তিনি সকলের কাছে অতি প্রিয়, তাই বোধহয় সকলেই আদর করে সম্ভাষণ করতেন “দাদাঠাকুর” নামে।
আসল নাম শরৎচন্দ্র পণ্ডিত। তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন বীরভূমের সিমলাদ্দি গ্রামে, মামারবাড়িতে। দিনটা ছিল ২৭ এপ্রিল, ১৮৭৯ সাল। তিনি ছিলেন সেই যুগের একজন অতি জনপ্রিয় গ্রামীণ সাংবাদিক।

গ্রামের পাঠশালা থেকে পড়াশোনা শেষ করে মুর্শিদাবাদের জঙ্গীপুর হাইস্কুলে ভর্তি হন। এরপর বর্ধমান কলেজে পড়াশোনা শুরু করেন। কিন্তু শৈশবে পিতৃমাতৃহীন শরৎচন্দ্র আর্থিক অসুবিধার কারণে আর পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারেননি। তিনি মুর্শিদাবাদ জেলার জঙ্গীপুরের দফরপুর গ্রামে থাকতেন। মাত্র ২১ বছর বয়সে, অর্থাৎ ১৯০২ সালে, তিনি নিজের বাড়িতেই একটি ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা করেন এবং নাম দেন “পণ্ডিত প্রেস”।
তিনি ঘুরে ঘুরে খবর সংগ্রহ করতেন, তারপর সেইসব খবর নিজের ছাপাখানায় ছাপতেন। “জঙ্গীপুর সংবাদ” নামে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা তিনি প্রকাশ করতেন। পরে তিনি আরেকটি পত্রিকা শুরু করেন — নাম “বিদূষক”।

নিজের ছাপাখানা সম্বন্ধে দাদাঠাকুর নিজেই রসিয়ে বলেছিলেন —
“আমার ছাপাখানার আমিই প্রোপ্রাইটর, আমিই কম্পোজিটর, আমিই প্রুফ-রিডার, আর আমিই ইঙ্ক-ম্যান। কেবল প্রেস-ম্যান আমি নই। সেটি ম্যান নয়, উওম্যান — অর্থাৎ আমার অর্ধাঙ্গিনী। ছাপাখানার কাজে ব্রাহ্মণী আমাকে সাহায্য করেন। স্বামী-স্ত্রী আমরা মিলে ছাপাখানা চালাই।”

দাদাঠাকুর যে কোনও দুর্নীতি বা ভ্রষ্টাচারের বিরুদ্ধে ছিলেন অত্যন্ত কঠোর সমালোচক। সামাজিক কিংবা প্রশাসনিক কুসংস্কার, অন্যায়, অবিচারের বিরুদ্ধে তিনি নির্ভয়ে রুখে দাঁড়াতেন। সেখানে কোনও আপোষ ছিল না। তখন তিনি বিদূষক নন, তখন তিনি বিদ্রোহী। তাই তিনি সকলের শ্রদ্ধেয়, স্মরণীয় এবং বরণীয় ব্যক্তিত্ব হয়ে উঠেছিলেন।

পণপ্রথাকে তিনি সমাজের ব্যাধি বলে মনে করতেন। যে বিয়েতে বরপণ দেওয়া-নেওয়া হতো, তিনি নিমন্ত্রিত হলেও সেখানে যেতেন না। আর যদি না জেনে গিয়ে ফেলতেন, তবে খোঁজ নিয়ে শুনলে যে বরপণ নেওয়া হয়েছে, সঙ্গে সঙ্গেই সেখান থেকে চলে আসতেন। তিনি বলতেন, এ ধরনের বিয়ে আসলে “ব্যাটা-পাঁটা বেচা বিয়ে”।

“জঙ্গীপুর সংবাদ” সে যুগের অন্যতম বলিষ্ঠ এবং জনপ্রিয় সাপ্তাহিক পত্রিকা হয়ে উঠেছিল। শুধু জঙ্গীপুরেই নয়, কলকাতার রাস্তায় রাস্তাতেও তিনি এই কাগজ, পরে তাঁর বিখ্যাত পুস্তিকা “বোতল পুরাণ” বিক্রি করতেন। কখনও গান গেয়ে, কখনও ছড়া কেটে কেটে নিজের লেখা বিক্রি করতেন। ভিড় জমত, বিক্রিও হতো প্রচুর।

একবার কলকাতার রাস্তায় “বোতল পুরাণ” বিক্রির সময় কয়েকজন ব্রিটিশ পুলিশ তাঁকে গ্রেফতার করতে আসে। দাদাঠাকুর তৎক্ষণাৎ একটি ইংরেজি গান বানিয়ে গেয়ে ওঠেন—

“I am coming from Murshidabad,
but not from Barham pore,
had I come from that very place,
all might have shut up the door….”

সেদিন সেই মজার গান শুনে ব্রিটিশ পুলিশরাই মুগ্ধ হয়ে ২০ কপি পুস্তিকা কিনে নিয়েছিল।

ইংরেজিতে যেমন Palindrome বা উভমুখী শব্দ রয়েছে, বাংলাতেও দাদাঠাকুর এর জনপ্রিয় প্রচলন ঘটান। তাঁর লেখায় প্রায়ই এ ধরনের শব্দ থাকত। যেমন — সীমার মাসী, বল খেলব, বই চাইব, তুমি কি মিতু, মার কথা থাক রমা, না বললে লব না, ওর মা আজ আমারও, মামাতো মামা, কাকাতো কাকা প্রভৃতি।

সেই যুগের দিকপাল ব্যক্তিত্বরা দাদাঠাকুরের প্রতি আকৃষ্ট ছিলেন — রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, কাজী নজরুল ইসলাম, নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ-সহ আরও অনেকে। সাহিত্যিক বনফুল (বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়) বলেছিলেন —
“দাদাঠাকুর সেই মানুষ, যার জন্য ধনীর প্রাসাদ থেকে গরিবের কুটীর — সর্বত্র শ্রদ্ধার আসন পাতা থাকত।”

তিনি কখনোই পায়ে জুতো পরতেন না। খালি পায়ে সারা রাজ্য ঘুরে বেড়াতেন। একবার এক সভায় তাঁকে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হচ্ছিল “পদস্থ ব্যক্তিদের সমাবেশ” বলে। দাদাঠাকুর রসিকতা করে বলেছিলেন —
“না না, এখানে সবাই জুতোস্থ মান্যবর, একমাত্র আমিই পদস্থ অমান্যবর।”
সঙ্গে সঙ্গে সভায় উপস্থিত সবাই হেসে উঠেছিল।

নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু তাঁকে অত্যন্ত শ্রদ্ধা করতেন। একবার দাদাঠাকুর নেতাজিকে বলেছিলেন —
“দ্যাখো সুভাষ, আমার স্থির বিশ্বাস তুমি-ই ব্রিটিশদের তাড়াবে।”
নেতাজি জিজ্ঞাসা করেছিলেন — “কীভাবে বুঝলে?”
তখন দাদাঠাকুরের উত্তর —
“কারণ তোমার নামের শুরুতেও ‘সু’, শেষেও ‘সু’। ইংরেজরা তোমার এই ঠোক্কর হজম করতে পারবে না। তোমার নামই সুভাষচন্দ্র বসু।”

কথার ফাঁকে ফাঁকে এমন রসিকতায় ভরা ছিল তাঁর জীবন। প্রচণ্ড শীতেও পরিধান শুধু একটি চাদর। কেউ কারণ জিজ্ঞাসা করলে তিনি কোমরের থলি থেকে এক পয়সা বের করে বলতেন — “বুঝলে হে, এ যে টাকার গরম।”

জঙ্গীপুরে তাঁর বাড়িতে বহু বিপ্লবী আশ্রয় নিয়েছিলেন।

বাংলা ও বাঙালির আত্মদর্পণ, এক বলিষ্ঠ সাংবাদিক দাদাঠাকুর তথা শরৎচন্দ্র পণ্ডিত জীবনের ৮৯ বছরের পরিসমাপ্তি ঘটান ১৯৬৮ সালের ২৭ এপ্রিল — তাঁর জন্মদিনেই। প্রায়শই তিনি বলতেন, “আমি টুক করে চলে যাব।” সত্যিই তিনি চলে গিয়েছিলেন মহাপ্রস্থানের পথে।

এই মানুষকে কি সহজে ভোলা যায়?
আজকের বঙ্গসমাজের কাছে প্রশ্ন থেকেই যায়।

মন্তব্য করুন

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.