প্রথম পাতা প্রবন্ধ ভাইফোঁটার উৎস, ইতিহাস ও ঐতিহ্য: প্রতিপদ না দ্বিতীয়া — কোথা থেকে শুরু এই ভালোবাসার উৎসব?

ভাইফোঁটার উৎস, ইতিহাস ও ঐতিহ্য: প্রতিপদ না দ্বিতীয়া — কোথা থেকে শুরু এই ভালোবাসার উৎসব?

138 views
A+A-
Reset

প্রতি বছর কার্তিক মাসের শুক্লপক্ষের দ্বিতীয় দিনে পালিত হয় ভাইফোঁটা, বাংলার এক চিরন্তন উৎসব যেখানে ভালোবাসা ও স্নেহে বাঁধা পড়ে ভাই ও বোনের সম্পর্ক। এই দিনটি শুধু রীতি বা আনুষ্ঠানিকতা নয়, এটি বাঙালির পারিবারিক বন্ধনের এক আবেগময় প্রকাশ।

তবে, অনেক জায়গায় ভাইফোঁটা বা ভ্রাতৃদ্বিতীয়া পালিত হয় এক দিন আগেই—কার্তিকের প্রতিপদে। বিশেষত পূর্ববঙ্গের রেওয়াজ অনুযায়ী বোনেরা ভাইদের ফোঁটা দেয় প্রতিপদের দিনেই। প্রথাগত ছড়া —
“প্রতিপদে ফোঁটা, দ্বিতীয়াতে নীতা, আজ হতে ভাই আমার যম দুয়ারে তিতা।”
এই কথাগুলিতেই ফুটে ওঠে বোনের প্রার্থনা—ভাই যেন দীর্ঘজীবী হয়, জীবনে সুখে থাকে।

লোকাচার ও কারণ

পূর্ববাংলা নদীপ্রধান অঞ্চল। মেঘলা আকাশ, হঠাৎ বৃষ্টি, নদীর প্রমত্ত স্রোত—সবই ছিল দৈনন্দিন বাস্তবতা। দূর দেশে থাকা ভাই বা দিদার ঘরে আসা সহজ ছিল না। তাই এক দিন আগে ফোঁটা দেওয়ার রেওয়াজ গড়ে ওঠে, যাতে প্রাকৃতিক বাধা এলেও বোন ভাইকে ফোঁটা দিতে পারে।

এই প্রতিপদের ভাইফোঁটায় ব্যবহৃত হত দই, চুয়া ও চন্দন, যা দ্বিতীয়ার ফোঁটার থেকে আলাদা। বোনের বিয়ে হয়ে গেলে সাধারণত প্রতিপদেই ফোঁটা দেওয়া হত—এ ছিল এক ধরনের সাংস্কৃতিক অভিযোজন, সময় ও দূরত্বের সঙ্গে রীতির মানিয়ে নেওয়া।

ঐতিহাসিক সূত্র

ভাইফোঁটার প্রচলনের প্রমাণ পাওয়া যায় ‘সর্বানন্দ সুন্দরী’ নামের এক তালপাতার পুঁথিতে, যেখানে উল্লেখ আছে, খ্রিস্টপূর্ব ৫২৭ অব্দে বঙ্গদেশে ভ্রাতৃদ্বিতীয়ার প্রথার সূচনা হয়। তবে এই প্রথার পেছনে আছে পুরাণ ও জৈন কাহিনি-ও। ত্রয়োদশ শতাব্দীর শেষভাগে মহাবীর জৈনের প্রয়াণে তাঁর ভগিনীকে সান্ত্বনা দিতে রাজা নন্দিত বর্ধন তাঁকে আহার করান। সেই ঘটনাকেই অনেকে ভাইফোঁটার উৎস বলে মনে করেন।

 লোকগীতি ও সংস্কৃতি

পূর্ববঙ্গের বহু অঞ্চলে ভাইফোঁটার দিনে গাওয়া হত বিশেষ গান—
“আশ্বিন যায় কাতিক আইয়ে গো, দ্বিতীয়ার চান্দে দিল দেখা…”
এই গানে ভাই-বোনের স্নেহ, বিচ্ছেদ, প্রতীক্ষা—সবই মিশে আছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই গান আজ হারিয়ে গেলেও তার আবেগ এখনও টিকে আছে প্রতিটি ফোঁটার চন্দনে।

সময়ের সঙ্গে বদল

আজ ডিজিটাল যুগে ভিডিও কলেই ভাই-বোনের দেখা হয়। প্রবাসী ভাইও হয়তো কেবল স্ক্রিনে ফোঁটা নেয়। তবুও মিষ্টি, নতুন জামা, আর ভালোবাসার উপহার নিয়ে দিদিরা তৈরি থাকেন ভাইফোঁটার দিনটির জন্য।

সময় বদলেছে, কিন্তু ভাইফোঁটার টান, সেই আদর আর প্রতীক্ষার উষ্ণতা আজও অপরিবর্তিত। ভাইফোঁটা শুধু এক উৎসব নয়, এটি বাংলার পারিবারিক সংস্কৃতির এক গভীর প্রতীক—যেখানে দায়িত্ব, স্নেহ ও সম্পর্কের দৃঢ় বন্ধন একসূত্রে বাঁধা। প্রতিপদ হোক বা দ্বিতীয়া, মূল সুর একটাই—ভালোবাসার আশীর্বাদ আর প্রার্থনার ফোঁটা।

আরও খবর

মন্তব্য করুন

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.