ইদানিং সারা দেশে একটা আলোচনা শোনা যাচ্ছে—আমাদের জন্মভূমি, মাতৃভূমি ভারতবর্ষের নাম “ভারত” তথা “ইন্ডিয়া” না হয়ে শুধু “ভারত” করা হোক। এই প্রস্তাবের পক্ষের মানুষের বক্তব্য, “ইন্ডিয়া” শব্দটি ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকতার ফসল। এসব কথা শুনে খুব স্বাভাবিকভাবেই আমরা সাধারণ মানুষ বিভ্রান্ত হয়ে পড়ছি এক দোদুল্যমানতায়। তাহলে আসল ইতিহাসটা কী?
এখানে আমরা যদি ইতিহাসকে দেখি, তাহলে আমাদের কাছে পরিষ্কার হয়ে যাবে আমাদের এই দেশের “ভারত”/ “ভারতবর্ষ”/ “হিন্দুস্তান” এবং “ইন্ডিয়া” নামের যথার্থতা ও যৌক্তিকতা।
ইতিহাস থেকে আমরা দেখতে পাই, খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীতে পারস্যের সম্রাট দারায়ুশ-এর লিখনে সিন্ধু উপত্যকাকে “ইউন্ডে” / “হিন্দুস্” বা “হিন্ডাস” / “ইন্ডাস” নামে অভিহিত করা হয়েছিল। এই পারসিক শব্দের অনুকরণেই পরবর্তীতে গ্রীক সম্রাট আলেকজান্ডারের (খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতক) ভারতবর্ষে আগমনের পর গ্রীক ঐতিহাসিক হেরোডোটাস লিখলেন—“ইন্ডে” বা “ইন্ডি (Inde)”, “ইন্ডোই (Indoi)”, “হিন্ডিকে” ইত্যাদি শব্দ। গ্রীক পর্যটক মেগাস্থেনিস লিখলেন “ইন্ডিকা” বা “ইন্ডিয়া”।
সিন্ধু নদের তীরে যে মানবসভ্যতার জন্ম হয়েছিল, সেই “সিন্ধু” শব্দ থেকেই আসা “হিন্দুস্” বা “ইন্দোস্” শব্দের সঙ্গে ভৌগোলিক ভূখণ্ডবাচক পারসিক প্রত্যয় “তান” (যেমন: আফগানিস্+তান = আফগানিস্তান, বেলুচ্স্+তান = বেলুচিস্তান, তাজিকিস্+তান = তাজিকিস্তান, উজবেকিস্+তান = উজবেকিস্তান, পাকিস্+তান = পাকিস্তান) যোগ হয়ে তৈরি হয়েছে “হিন্দুস্+তান = হিন্দুস্তান”।
একইভাবে গ্রিক-রোমান ভাষায় ভূখণ্ডবাচক প্রত্যয় “ইয়া” (যেমন: সার্বিয়া, সিরিয়া, এশিয়া ইত্যাদি) যুক্ত হয়ে গঠিত হয়েছে “ইন্ডিয়া”। শত শত বছর আগে থেকেই বিশ্বের কাছে এই নাম প্রচলিত এবং প্রবাহমান।
আমাদের দেশে মোগল, শক, হুন, ব্রিটিশ প্রভৃতিরা অনুপ্রবেশের বহু বহু আগে থেকেই বিশ্বের কাছে “ইন্ডিয়া” নামটির প্রচলন ছিল। ক্রিস্টোফার কলম্বাসও স্পেন থেকে বেরিয়েছিলেন ইন্ডিয়ায় আসবেন বলে, কিন্তু ভুল করে পৌঁছে গেলেন দক্ষিণ আমেরিকার এক স্থানে। সেখানকার লালচে তামাটে চামড়ার মানুষদের তিনি নাম দিলেন রেড ইন্ডিয়ান। সালটি ছিল ১৪৯২।
ভারত নামের ইতিহাস আরও প্রাচীন। বৈদিক যুগ থেকেই এই নাম পরিচিত। শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায় “ভারত” নামের উল্লেখ রয়েছে। বৌদ্ধ যুগেও “ভারত” প্রচলিত ছিল। ভারতের প্রাচীন নামগুলির মধ্যে রয়েছে—“আর্যাবর্ত”, “জম্বুদ্বীপ” প্রভৃতি।
তাই আমাদের দেশ যাহা “ভারত”, তাহাই “হিন্দুস্তান”, আর তাহাই “ইন্ডিয়া”। বহু শতাব্দী ধরে এই নামগুলি একসঙ্গে প্রবাহমান। সেই ঐতিহাসিক ঐতিহ্য ও পরম্পরায় আমাদের দেশ, আমাদের জন্মভূমি, আমাদের মাতৃভূমি পরিচিত হয়ে এসেছে।
অতএব, শুধু “ভারত”, ইন্ডিয়া নয়—এই ভাবনা অত্যন্ত সংকীর্ণ, যা আমাদের সংস্কৃতির পরিপন্থী। আর বোধহয় আমাদের দেশের সংবিধান প্রণেতাদেরও এই সংকীর্ণতা ছিল না। তাই সংবিধানের শুরুতেই লিপিবদ্ধ করা আছে—
“India, that is Bharat…”
এই কথাটি লিখতে তাঁদের কোনও অসুবিধা হয়নি।
আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনেও “ভারত ছাড়ো” আর “Quit India”, এবং “সারে জাঁহাসে আচ্ছা হিন্দুস্তাঁ হামারা”—এই উচ্চারণগুলিই ছিল ইতিহাসের নিয়ামক শক্তি।
স্বামী বিবেকানন্দ শিকাগোতে তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণে বলেছিলেন:
“My Motherland India is the mother’s affectionate lap of all religions of the world.”
একইসঙ্গে তিনি এ-ও বলেছিলেন—
“হে ভারত, ভুলিও না তোমার নীচ জাতিকে… হে বীর, সাহস অবলম্বন করো, সদর্পে ডাকিয়া বলো, মূর্খ দরিদ্র ভারতবাসী আমার ভাই, আমার বোন…”।
নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর আজাদ হিন্দ ফৌজের পারস্পরিক সম্ভাষণ ছিল “জয় হিন্দ”। (১৯৪০-৪১ সালে আজাদ হিন্দ বাহিনীর মেজর আবিদ হোসেন সাফরানি প্রথম এই স্লোগানটি দেন। নেতাজী সিদ্ধান্ত নেন, এটাই হবে বাহিনীর সেনানীদের পারস্পরিক অভিবাদনের শব্দ।)
আজাদ হিন্দ বাহিনীর কুচকাওয়াজের গান ছিল—
“কদম কদম বাড়ায়ে যা, খুশী কে গীত গায়ে যা,
ইয়ে জিন্দেগী কৌম কি, তু কৌম পে লুটায়ে যা…”
(এই গানটি লিখেছিলেন মেজর বংশীধর শুক্লা এবং সুর দিয়েছিলেন মেজর রাম সিং ঠাকুরী)।
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ লিখলেন—“হে মোর চিত্ত, পূণ্য তীর্থ জাগোরে ধীরে, এই ভারতের মহামানবের সাগরতীরে।”
উর্দু কবি ইকবাল লিখলেন—“সারে জাঁহা সে আচ্ছা হিন্দুস্তাঁ হামারা, হামারা…”
তাই আমরা পরিচিত হব ভারতবাসী বলে, আমরা পরিচিত হব ইন্ডিয়ান বলে। আমাদের দেশ পরিচিত হবে বিশ্বের কাছে ভারত, ইন্ডিয়া, হিন্দুস্তাঁ—এই নামগুলির ঐতিহাসিক ঐতিহ্য ও পরম্পরার দাবিতে, আমাদের অধিকারে।
অতএব, আমাদের দেশকে নিয়ে কোনও সংকীর্ণতা বা কূপমণ্ডূকতা আমরা কখনোই বরদাস্ত করব না।