প্রথম পাতা প্রবন্ধ ‘মহিষাসুরমর্দিনী’—সর্বধর্ম সমন্বয়ের অনন্য নজির

‘মহিষাসুরমর্দিনী’—সর্বধর্ম সমন্বয়ের অনন্য নজির

641 views
A+A-
Reset

পঙ্কজ চট্টোপাধ্যায়

” মহিষাসুরমর্দিনী” আলেখ্য-গাথাটির রচয়িতা ছিলেন আর এক কিংবদন্তি  বাণীকুমার, যাঁর আসল নাম বৈদ্যনাথ ভট্টাচার্য।

১৯২৭-২৮ সালে একটি ঘরোয়া আড্ডাতে সেই সময়ের রেডিও-র কর্তা নৃপেন্দ্রনাথ মজুমদারের আগ্রহে আর প্রেমাঙ্কুর আতর্থী, বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র,পঙ্কজ কুমার মল্লিক,বাণীকুমার, রাইচাঁদ বড়াল, নিমাই চাঁদ বড়াল, প্রমুখদের আলাপচারিতায় এবং পরিকল্পনায় বসন্তকালে বাসন্তীপুজোর উৎসবের প্রাক্কালে একটি আলেখ্য অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা করা হয়।  সেই অনুষ্ঠানের নাম ছিল “বসন্তেশ্বরী”। যা বাসন্তী পুজোর ষষ্ঠীর ভোরে প্রচারিত হয়েছিল (একবার)।

তারপর,১৯৩২ সালে ( ১৩৩৯ বঙ্গাব্দে) আশ্বিন মাসে এই অনুষ্ঠানটি রেডিওতে “শারদ বন্দনা” নামে প্রচারিত হয়। তখন রেডিও স্টেশন ছিল ১ নং গাস্ট্রিন প্লেসে। এরপর, ১৯৩৪ সালের ৮ই অক্টোবর (১৩৪১ বঙ্গাব্দ) অনুষ্ঠানটি মহালয়ার দিন সকাল ছ’টা থেকে সাড়ে সাতটা অবধি প্রচারিত হয়। কিন্তু প্রচারের পর উঠেছিল প্রতিবাদ. কিছু সীমাবদ্ধতার মনের মানুষ হৈচৈ ফেলে দিলেন.’সে কি? এক কায়েতের ছেলে, অব্রাহ্মণ্ ব্যক্তি চণ্ডীপাঠ করবে? এ কি অনাচার? আর মহালয়ার দিন তো পিতৃতর্পণের দিন–তার আগেই দেবীর আবাহনে চণ্ডীপাঠ ?’ ইত্যাদি,ইত্যাদি।

মহিষাসুরমর্দিনীর প্রথম গান মালকোষ রাগে।মালকোষ রাগ হল রাত্রিশেষের রাগ।দ্বিতীয় গানটি ভৈরব রাগে–এইভাবে চলতে থাকে দিনের প্রথম ভাগের রাগাশ্রিত সুর-তালে আবদ্ধিত সঙ্গীতগুলি। সঙ্গীত আয়োজনে আর এক কিংবদন্তি পঙ্কজ কুমার মল্লিক। সঙ্গীতের সঙ্গতে ছিলেন “সর্ব ধর্ম সমন্বয়”-র মানুষজন। যেমন,মহাপুরুষ মিশ্র, রাধাকান্ত নন্দী,কেরামতুল্লা খান, এন্টনী গোমস,সাগিরুদ্দিন খান,খুশি মহম্মদ, আলি বক্স,রাধাকান্ত নন্দী,দূর্বাদল চট্টোপাধ্যায়,চন্দ্রকান্ত শীল, প্রমুখ। গানে ছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, শিপ্রা বসু,সুপ্রীতি ঘোষ,শ্যামল মিত্র,সত্য চৌধুরী, দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়, ইলা বসু,আরতি মুখোপাধ্যায়, বিমল ভূষন,মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়,তালাত মামুদ(প্রথম দিকে ছিলেন),উৎপলা সেন,রাইচাঁদ বড়াল,পঙ্কজ কুমার মল্লিক, প্রমুখ,প্রমুখ।

অনেক সময়ে ধর্মের ভাবাবেগ মানুষকে অন্ধ-উগ্র করে দেয়। তখন সমাজের শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষদের তার বিরুদ্ধে সুদৃঢ় মনোভাব নিয়ে রুখে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করেন। সেই সময়েও তাই করেছিলেন কিছু উদার মনের মানুষ। পরবর্তী কালে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র স্মৃতিচারনায় লিখেছেন..”নৃপেনবাবু তা শুনে বলেছিলেন প্রোগ্রাম করবে, তার আবার বামুন কায়েতে কি হে? আমরা কি হিন্দুর মন্দিরে গিয়ে পুজো করছি? তা হলে তো আমাদের এই প্রোগ্রামে যারা বাজাবে,গাইবে, তারা তো কেউ মুসলমান,কেউ খ্রিস্টান, কেউ হিন্দু, আবার কেউ ব্রাহ্মণ,কেউ অব্রাহ্মণ, এই তো আলি আছে,মুনশি আছে,এণ্টনী আছে,আবার মুখুজ্যে-বাঁড়ুজ্যে-চাটুজ্যে-ঘোষ-বোস- সবাই আছে, তাতে কার কি এসে গেল? ওসব কে কি বলল,না বলল কিচ্ছু এসে যায় না। প্রোগ্রাম হবেই আর যারা আছে,তারাই করবে।” বীরেন্দ্রকৃষ্ণ আরো লিখেছেন” বাণীকুমার রুখে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন- চণ্ডীপাঠ আর গ্রন্থনা বীরেন্দ্রকৃষ্ণই করবেন,তার অন্যথা হবেনা।”

অবশ্য পরের দু’বছর ১৯৩৫ এবং ১৯৩৬ সালে অনুষ্ঠানটি মহাষষ্ঠীর ভোরে প্রচারিত হয়েছিল। অবশেষে  বাণীকুমার,বীরেন্দ্রকৃষ্ণ,পঙ্কজ  কুমার, প্রমুখরা সিন্ধান্ত নিয়ে ১৯৩৭ সাল থেকে মহালয়ার ভোরে “মহিষাসুরমর্দিনী” রেডিওতে প্রচারিত হতে শুরু করে,যা আজ ৮৪ বছর ধরে চলে আসছে।

মাঝখানে ১৯৭৬ সালের ২৩ শে সেপ্টেম্বর সারাদেশে জরুরী অবস্থা চলাকালীন এক অদৃশ্য নির্দেশে “মহিষাসুরমর্দিনী” অনুষ্ঠানটি প্রচার না করে আকাশবাণী নতুন প্রথিতযশা শিল্পীদের নিয়ে (পাঠে উত্তমকুমার,কাজী সব্যসাচী,  ধ্যানেশ্নারায়ন চক্রবর্তী, প্রমুখ এবং গানে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, মান্না দে,লতা মঙ্গেশকর,আশা ভোঁশলে,মহম্মদ রফি,প্রমুখ) “দেবী দূর্গতিহারিনীম” সম্প্রচারিত হয়েছিল। সেটি রচনা করেছিলেন বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগের তৎকালীন প্রধান ডঃ ধ্যানেশনারায়ন চক্রবর্তী।  কিন্তু, অনুষ্ঠান প্রচারের শেষে রেডিও স্টেশনের সামনে সাধারণ মানুষ জনরোষে, বিক্ষোভে ফেটে পড়েছিল। এই অনুষ্ঠানটির বিষয়ে আকাশবাণী বীরেন ভদ্রের সাথে,পঙ্কজ মল্লিকের সাথে,বাণীকুমারের সাথে কোন আলোচনাই করেনি।যার জন্য খুব কষ্ট পেয়েছিলেন তাঁরা। তাই পরে আকাশবাণীর কর্তৃপক্ষ তাঁদের কাছে ক্ষমা চান,স্বয়ং উত্তমকুমার,সব্যসাচী, হেমন্ত বাবু,মান্নাদে,লতাজী,আশাজী,মহম্মদ রফি সাহেব প্রমুখরাও ক্ষমা চেয়েছিলেন। তারপরে সেই বছর-ই মহাষষ্ঠীর ভোরে আকাশবাণী কর্তৃপক্ষ আবার “মহিষাসুরমর্দিনী” আলেখ্যটি প্রচার করেন। এখানে উল্লেখ্য,যে,মহালয়ার ভোরে এই অনুষ্ঠান আগে রেডিও থেকে লাইভ অনুষ্ঠান হিসাবে অনুষ্ঠিত হত। স্টুডিওতে সকল শিল্পীরা আসতেন মাঝরাতে। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র গঙ্গাস্নান করে গরদের পোষাক পরে আসতেন,তখন তিনি যেন এক মহা-ঋত্বিক,মহা-স্তোতৃ পুরুষ।

থাকতো মা দুর্গার এক চালচিত্রের প্রতিমা। সকল জাতি-ধর্মের শিল্পীদের নিয়ে সে এক অনির্বচনীয় পরিবেশ তৈরী হত আকাশবাণীর কলকাতা কেন্দ্রে। পরে ১৯৬৬ সালে মহিষাসুরমর্দিনীর অনুষ্ঠানটি রেকর্ড করা হয়।সেই রেকর্ডই তারপর থেকে মহালয়ার ভোরে রেডিওতে সম্প্রচারিত হয়ে আসছে।

ইন্ডিয়ান অডিয়েন্স রিসার্চ ব্যুরো-র ২০১৮ সালের একটি সমীক্ষার তথ্য বলছে যে,মহালয়ার ভোরে “মহিষাসুরমর্দিনী” প্রভাতী অনুষ্টানের শ্রোতা বাংলাতে ৯৭ শতাংশ,এবং সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে বিভিন্ন ভাষাতে প্রচারিত হওয়া এই অনুষ্ঠানটির শ্রোতা ৯৮.৪ শতাংশ। এই অনুষ্টানের আর একটি বিশেষত্ব হোল,যে একটানা প্রায় নয় দশক ধরে একইভাবে প্রচারিত হয়ে আসছে,যার কদর এতটুকুও কমেনি। যে অনুষ্ঠান রবীন্দ্রনাথ,কাজী নজরুল,নেতাজী সুভাষ,জগদিশ চন্দ্র,প্রমুখ  দিকপাল বাংলা তথা ভারতীয় রত্নরা শুনেছিলেন,সেই অনুষ্ঠান আজও আমরা শুনছি পরম আগ্রহে,সমাদরে।

বাঙালী যতদিন থাকবে,মহালয়ার ভোরে সেই ব্যারিটোন ভয়েসে “যা দেবী সর্বভুতেষু মাতৃরূপেন সংস্থিতা,নমোস্তস্যই,নমোস্তস্যই,নমোস্তস্যই,নমো,নমোহঃ…”উচ্চারনের সাথে সাথে, “বাজলো তোমার আলোর বেনু.”  “জাগো দুর্গা,জাগো দশপ্রহরণধারিনী,” ইত্যাদি গানগুলি নিয়ে “মহিষাসুরমর্দিনী”-তে দেবীর আবাহন গীতি-আলেখ্যও চির অম্লান হয়ে থাকবে।

মন্তব্য করুন

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.