পঙ্কজ চট্টোপাধ্যায়
মাঝে মাঝে আশ্চর্য লাগে, যে আমাদের দেশের স্বাধীনতার ৭৫ বছর পরেও এই দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের সঠিক ইতিহাস আজও আমরা জানতেই পারলাম না। কতো শত সহস্র বীর-বীরাঙ্গনা দেশপ্রেমে নিবেদিত বিপ্লবীদের সম্মন্ধে কিছুই জানলাম না, প্রজন্মের পর প্রজন্ম। বাংলা-সহ দেশের বিভিন্ন প্রদেশের, এবং সারা ভারতবর্ষের ইতিহাসে সেইসব বীরাঙ্গনা এবং বীর বিপ্লবীদের কোনো কথাই আজও লেখা হয়নি। এ এক চরম অন্যায় অবিচার।শুধু কতিপয় নেতাদের কথা ছাড়া।
ইতিহাসের উপেক্ষিত সেইরকম এক বীরাঙ্গনা বঙ্গনারীর কথাই আজ আমরা স্মরণ করে তাঁর চরণ ছুঁয়ে যাব বিনম্র শ্রদ্ধায়।
তিনি হলেন মোহনী দেবী। স্বামী বিবেকানন্দ যে বছর জন্মেছিলেন, সেই ১৮৬৩ সালেই এই মোহিনী দেবী অবিভক্ত বাংলার ঢাকা শহরে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। বাবার নাম ছিল রামশঙ্কর সেন,আর মায়ের নাম ছিল শ্রীমতী লীলাবতী দেবী।
তখনকার সামাজিক নিয়মেই মোহিনী দেবীর ১২ বছর বয়সে তারকচন্দ্র দাশগুপ্ত-এর সঙ্গে বিয়ে হয়।পরে এই তারকচন্দ্র বাবু রায়বাহাদুর খেতাব পেয়েছিলেন। বিয়ের পরে মোহিনী দেবী কলকাতায় চলে আসেন,এবং পড়াশোনার প্রতি তাঁর অদম্য আগ্রহের জন্য তিনি সদ্য স্থাপিত ভিক্টোরিয়া স্কুলের প্রথম ছাত্রী হিসাবে ভর্তি হন। সেখানে তিনি শিক্ষালাভ করেন রামতনু লাহিড়ী, শিবনাথ শাস্ত্রী, প্রমুখ তখনকার দিকপাল মনীষীদের কাছে। পরে ইংরাজি শিক্ষার জন্য তিনি ভর্তি হন ইউনাইটেড মিশন-এ।সেখানে তিনি পড়ার সময়েই তার সাথে পরিচয় হয়েছিল অনেক ব্রিটিশ বিদুষী শিক্ষিকাদের। সকলেই মোহিনী দেবীকে খুবই ভালোবাসতেন।
মোহিনী দেবী ছোটবেলা থেকেই সমাজের বিভিন্ন প্রকারের হিতকর কাজে নিজেকে নিয়োজিত করে রাখতেন।
তিনি সামাজিক সেবামূলক কাজে যুক্ত হয়েছিলেন স্বামী বিবেকানন্দের অনুপ্রেরণায়।তিনি ভগিনী নিবেদিতার সাথে কলকাতায় প্লেগ মহামারীতে মানুষের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করেছিলেন। তাঁকে সহযোগিতা করেছিলেন ডাক্তার রাধাগোবিন্দ কর(ডাক্তার আর.জি.কর নামে বিখ্যাত)। মোহিনী দেবী কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ,ঋষি অরবিন্দ প্রমুখদের সান্নিধ্য পেয়েছিলেন। সান্নিধ্য লাভ করেছিলেন শ্রীমা সারদা-র।
সমাজের সেবাতে আত্মনিয়োগের পাশাপাশি তিনি দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের সাথেও সক্রিয়ভাবে যুক্ত হয়েছিলেন। সেইসূত্রে তিনি দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ,নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু,কাজী নজরুল ইসলাম,মহাত্মা গান্ধী, বিপিনচন্দ্র পাল,মুজফফর আহমেদ প্রমুখদের সাথে দেশের কাজ করেছেন। ১৯৩০-৩১ সালে ব্রিটিশ সরকার মোহিনী দেবীকে একবছর কারাবন্দী করে রেখেছিল দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে সক্রিয় ভুমিকার জন্য।
জেল থেকে বেরিয়ে তিনি সাম্যবাদী বামপন্থী রাজনীতির সাথে যুক্ত হন। তিনি নিখিল ভারত মহিলা সম্মিলনীর সর্ভারতীয় সভানেত্রীর দায়িত্ব পালন করেছিলেন।সারা দেশ জুড়ে তিনি সংগঠন তৈরী করেছিলেন।
১৯৪৬ সালে সারা দেশে রক্তক্ষয়ী দাঙ্গার সময়ে তিনি কলকাতার এন্টনীবাগানের নিজের বাড়িতে অসহায় হিন্দু-মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষদের নিরাপদ আশ্রয় দিয়েছিলেন। তিনি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির প্রচারে সারা বাংলা সেদিন চষে বেড়িয়েছিলেন।
কলকাতার বস্তিতে বস্তিতে তিনি অন্যান্য নারীদের সংগঠিত করতেন সামাজিক,সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষা এবং প্রতিষ্ঠার কাজে।
সারা জীবন তিনি দেশের এবং দেশের মানুষের জন্য নিজেকে নিয়োজিত করে গিয়েছেন নিঃস্বার্থ ভাবে।
১৯৫৫ সালের ২৫ মার্চ মোহিনী দেবী আমাদের ছেড়ে মহাপ্রস্থানের পথের একাকী পথিক হয়ে যান।
এই মহীয়সী নারী আমাদের দেশের ইতিহাসে আজও উপেক্ষিতা হয়ে আছেন। গতকাল ২৫ মার্চ ছিল তাঁর মৃত্যুদিন… আমরা তাঁর প্রতি এবং তাঁর চিরবিদায়ের দিনের প্রতি রেখে গেলাম আমাদের দেশের মানুষের সশ্রদ্ধ প্রণাম।