মহানিষ্ক্রমণের ঠিক আগের মুহূর্ত…

পঙ্কজ চট্টোপাধ্যায়

অবশেষে এল ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসের সেই অবিস্মরণীয় মুহুর্তের দিন…১৯৪১ সালের শীতকালের ১৭ই জানুয়ারী।

একটু আগে পরম প্রিয় জননীকে প্রণাম করে আশীর্বাদ নেওয়া হয়ে গেছে। মায়ের চোখের জল নিজের হাতে আশীর্বাদী করে নিজের মাথায়,কপালে,বুকেতে মেখে নেওয়া হয়ে গেছে। মা তাঁর ঘরে ঘুমোচ্ছেন। বাড়ির সকলেই নিদ্রামগ্ন পরম নিশ্চিন্তে। শুধু তিনি ছাড়া।

প্রস্তুত তিনি। প্রস্তুত গোপনে ভগৎরাম তলোয়ার। প্রস্তুত ভারতের উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের ফরোয়ার্ড ব্লক নেতা পেশোয়ারের আকবর শা।প্রস্তুত পাঞ্জাবের কীর্তি কিষাণ পার্টির নেতৃবৃন্দ। প্রস্তুত অবিভক্ত বাংলার বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স-এর অন্যতম নেতা হেমচন্দ্র ঘোষ, সত্য বক্সী, ঘোষ, যতীশ গুহ, বিনয় সেনগুপ্ত, প্রমুখরা।

বাইরে ব্রিটিশ সরকারের পুলিশের আর গোয়েন্দাদের কড়া পাহারা। বাড়িতে বিভিন্ন মানুষের আসাযাওয়া।সারা দেশ,সারা বিশ্ব জানে তিনি অসুস্থ,বিছানায় শয্যাশায়ী। ডাক্তার,হেকিম,আসা যাওয়া করছে। সবাই খুবই চিন্তিত। তারই মধ্যে তিনি নিয়েছেন এক চরম৷ সিদ্ধান্ত এবং পরিকল্পনা। সেই সময় এই মুহূর্তে এসে গেছে। আর দেরি নয়।
রাত তখন ১টা বেজে ২৫ মিনিট। সারা বাংলা,সারা ভারত ঘুমোচ্ছে।গোটা এলগিন রোড নিস্তব্ধ। আলো টিমটিম করে জ্বলছে।জনমানবহীন রাস্তা।শুধু জ্বলছে আকাশের নক্ষত্রগুলো। আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়ালেন সুভাষ চন্দ্র বসু। এবার বেরিয়ে পড়তে হবে।আর সময় নেই।

কিন্তু, এ কোন্ সুভাষ? এ তো এক পাঠান। লম্বা চওড়া তেজোদ্দীপ্ত। খুব কষ্ট হচ্ছে মায়ের জন্যে।এই চেনা ঘর,বাড়ি,শহর ছেড়ে যেতে,কিন্তু যেতে যে হবেই,কারন জন্মভূমির পরাধীনতার শৃঙ্খল যে তাঁকেই ছিন্ন করতে হবে।সে তো জন্ম বিপ্লবী। ভিক্ষা মেগে তো স্বাধীনতা হয়না।তার জন্য লড়াই করতে হয়,আত্ম- বলিদান দিতে হয়,আত্মত্যাগ করতে হয়,এটাই পৃথিবীর ইতিহাস।স্বাধীনতার জন্য তাই সুভাষ নিজের বুকের রক্ত দিতে প্রস্তুত, নিজের জীবন দিতেও তিনি রাজি।কিন্তু দেশমাতৃকার মুক্তি চাই।সেই মুক্তির মহামন্ত্রে তিনি দীক্ষিত।মুক্তির মন্দির সোপানতলে কতো প্রান বলিদান দিয়েছেন এই দেশের বীর সন্তানরা তাদের সেই আত্মবলিদানের শপথেই সুভাষ আজ সুদৃঢ় সংকল্পে বলীয়ান।

বুঝি এক লহমার ব্যাপার।সুভাষ নিঃশব্দে দৃপ্ত পদক্ষেপে নেমে গেলেন নীচে। উঠলেন অপেক্ষায় থাকা গাড়িতে। যাত্রা শুরু হোল তাঁর। ছুটছে গাড়ি।একসময়ে মিলিয়ে গেল গাড়ি কুয়াশায় গাঢ় অন্ধকারের আড়ালে।

রাত ১টা ৩৫ মিনিট। পেরিয়ে যাচ্ছে গাড়ি এসপ্ল্যানেডের মনুমেন্ট। ছুটে চলেছে গাড়ি.. হাওড়া.. বেলুড়… বালি… উত্তরপাড়া… চন্দননগর.. . শক্ত হাতে স্টিয়ারিং ধরে আছেন শিশির বসু, আর নিস্পন্দভাবে বসে আছেন পিছনের সীটে সুভাষ চন্দ্র। তাঁর দুচোখের স্বপ্নে ভাসছে লালকেল্লা,ভাসছে লালকেল্লায় উড়ছে স্বাধীন ভারতবর্ষের তেরঙ্গা জাতীয় পতাকা। ধ্বণিত হচ্ছে লক্ষ কোটি কন্ঠে.. “বন্দে মাতরম..”। সামরিক বাহিনীর ব্যান্ড সুর তুলছে.. “জনগনমন অধিনায়ক জয় হে,ভারতভাগ্য বিধাতা…”।

গাড়ি ছুটে চলেছে তার পথ ধরে। সুভাষচন্দ্রের মনে অজ্ঞাতেই বুঝি সেই জ্যোতির্ময় পুরুষের মুখখানি ভেসে ওঠে, চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছেন স্বামী বিবেকানন্দ-কে। এদেশের জাতীয়তাবাদ আন্দোলনের পথিকৃৎ কে। দেখতে পাচ্ছেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর-কে..,যিনি সুভাষকে সন্তানের চেয়েও বেশী ভালোবাসেন,বলেছেন..সুভাষতুমিই এদেশের,এ জাতির সর্বাধিনায়ক…এদেশ তোমার অপেক্ষাতেই প্রহর গুনে যায়..”।

গাড়ি চলছে..ব্যান্ডেল-শক্তিগড়- বর্ধমান-আসানসোল -বরাকর সেতু…..। ভোর হয়ে আসছে।এবার পরিকল্পনা মত বিরতি নিতে হবে।

ধানবাদের কাছাকাছি বারারীতে একটি বাড়িতে থাকবেন সারাদিন।সেই বাড়িটি হল নেতাজীর মেজদাদা শরৎচন্দ্র বসুর বড়ো ছেলে অশোক বসুর(শিশি বসুর দাদা)।

আবার যাত্রা শুরু হবে রাত্রে। এখানে তাঁর পরিচয় একজন পাঠান,শিক্ষিত,ইনসিওরেন্স কোম্পানির এজেন্ট।

সারাদিন গেল। সূর্য অস্ত যাবার পরে শুরু হোল আবার পথচলা। গাড়ি এসে থামলো গোমো জংশন। রাত তখন অনেক। এখনও অপেক্ষা করতে হবে এক ঘণ্টা। দিল্লী-কালকা মেলের জন্য।

স্টেশন থেকে একটু দূরে গাড়িতেই কিছু কথাবার্তা হল।উপস্থিত ছিলেন শিশির বসু,অশোক বসু এবং অশোক বসুর স্ত্রী।তারপর যখন সিগন্যাল ডাউন হল,ট্রেন আসার সময় হোল,তখন নিমেষে প্রস্তুত হয়ে নিলেন সুভাষ। চারিদিক ভালো করে দেখে নিয়ে নেমে পড়লেন গাড়ি থেকে। এগিয়ে গেলেন দৃঢ পদক্ষেপে প্ল্যাটফর্মের দিকে। পিছনে তাকালেন না কারও দিকে..।

বিদায়, বিদায়..এবার তোমরা যাও।আমার পথ একার পথ।অনেক বাধা বিপত্তি পেরিয়ে আমাকে পৌঁছাতে হবে আমার একমাত্র সেই লক্ষ্যে, যার নাম আমার জন্মভূমির, আমার মাতৃভুমির স্বাধীনতা।

সুভাষ চলে যাচ্ছেন। ট্রেনে উঠে পড়লেন। কত গ্রীষ্ম, কত বসন্ত,কত কান্না-হাসির মালায় গাঁথা শৈশব, যৌবনের দিনগুলোকে পেছনে ফেলে সুভাষ আজ চলে যাচ্ছেন মহানিশায় মহানিষ্ক্রমনে ভারতের স্বাধীনতার স্বপ্নকে বাস্তবে রূপায়িত করার মহামন্ত্র নিয়ে মহান লক্ষ্যে।

ঐ যে ট্রেন অন্ধকারে মিলিয়ে যাচ্ছে সুভাষকে নিয়ে।ঐ যে গাড়ির পেছনের লাল আলোটা ক্রমশ ছোট হতে হতে হারিয়ে যাচ্ছে একটু একটু করে রাতের গাঢ় নিকষকালো অন্ধকারে।

হে সর্বত্যাগী রুদ্র সন্ন্যাসী, এ সময়ে চোখের জল ফেলে তোমার যাত্রাপথকে আমরা পিচ্ছিল করে তুলব না।
তুমি যাও, তোমার মহানিষ্ক্রমনের যাত্রাপথ শুভ হোক।

আমরা অপেক্ষায় রইলাম।আবার তুমি ফিরে এসো তোমার মহান ব্রত সফল উদযাপন করে।ফিরে এসো স্বাধীন ভারতবর্ষে। ফিরে এসো তুমি বিজয়ীর বেশে। ততদিন আসমুদ্রহিমাচল তোমার ভারতবর্ষ, কোটি কোটি মানুষের ভারতবর্ষ তোমার পথ চেয়ে দিন গুনবে।
অপেক্ষায় থাকবো আমরা।

জয়তু নেতাজী। বন্দেমাতরম.. ইনকিলাব জিন্দাবাদ।

আজও ভারতবর্ষের মানুষ তোমার অপেক্ষায় দিন গোনে। জানি তুমি হয়তো ফিরবেনা আর কোনদিন,তবুও এদেশ,এদেশের মানুষ তোমার অপেক্ষায় দিন গোনে। কারণ, এদেশ জানে,এদেশের মানুষ বিশ্বাস করে মনেপ্রাণে যে,নেতাজী সুভাসচন্দ্র বসুর জন্মদিন আছে,চিরবিদায়ের দিন নেই। তিনি অমর, অব্যয়, অক্ষয়, তিনি আমাদের প্রানের, তিনি আমাদের আত্মার আত্মীয়।

Related posts

‘মহিষাসুরমর্দিনী’- কিছু অজানা কথা

‘ইন্ডিয়া দ্যাট ইজ ভারত’, কিছু ঐতিহাসিক তথ্য

তিনিই ছিলেন একমাত্র “ঐক্যপুরুষ”