পঙ্কজ চট্টোপাধ্যায়
বাংলার ইতিহাসে, সংস্কৃতিতে, ভুগোলে, সমাজবিজ্ঞানে, আধ্যাত্মিকতায়, স্থাপত্যে, জনগণ চেতনায় এবং সমাজ সেবায়, মানুষের কল্যাণে নিবেদিত এক ঐতিহাসিক নাম হল ” রাণী রাসমণি।
১৭৯৩ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর হালিশহরে রাসমণি-র জন্ম। বাবা ছিলেন একজন অতি সজ্জন মানুষ হরেকৃষ্ণ দাস, আর মায়ের নাম ছিল শ্রীমতী রামপ্রিয়া দাস।
রাণী রাসমণির বিয়ে হয়েছিল ১১ বছর বয়সে কলকাতার জানবাজারের সেইযুগের অতি ধনবান সজ্জন মানুষ জমিদার রাজচন্দ্র দাসের সঙ্গে। অত্যন্ত রূপবতী ছিলেন রাণী রাসমণি দেবী। অমরাবতীর দেবী মায়ের মতো ছিল তাঁর রূপ।
রাণী রাসমণি অত্যন্ত স্বাধীনচেতা, তেজস্বিনী,ভক্তিপরায়না, এবং প্রজা তথা মানব দরদী স্বভাবের মহিলা ছিলেন।
তৎকালীন ইংরেজ সরকার,নীলকর সাহেবরা এই “রাণী-মা”-কে যথেষ্ট সমীহ করে চলতেন।কারন এই ইংরেজ সরকার,নীলকর সাহেবরা নানা অছিলায় নিরীহ সাধারণ মানুষের ওপরে নানান অন্যায় অত্যাচার করতো। প্রজারা এসে রাণীমা-কে জানালেই,তিনি সঙ্গে সঙ্গে তাদের পক্ষ নিয়ে ব্রিটিশের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে পড়তেন।
আজকের এসপ্ল্যানেড অঞ্চলটিতে ইংরেজরা নানা আছিলায় জবর দখল করে আশেপাশের সাধারণ মানুষের যাতায়াতের পথ বন্ধ করে দিয়েছিল।রাণীমার কানে এই খবর যেতেই তিনি সেইসময় ১ লক্ষ টাকা দিয়ে এসপ্ল্যানেড থেকে পশ্চিমে গঙ্গার পাড় অবধি কিনে নেন,এবং সাধারণ মানুষের জন্য বাবু রাজচন্দ্র ঘাট(বাবুঘাট) তৈরী করে দেন।
রাণী রাসমণি এছাড়াও তৈরী করে দিয়েছিলেন সুবর্ণরেখা নদীর পাড় থেকে পুরী পর্যন্ত রাস্তা তীর্থযাত্রীদের জন্য। হাওড়ার ঘুসুরী থেকে মেটিয়াবুরুজ অবধি রাস্তা তৈরী করে দেন তিনি যাতে মেটিয়াবুরুজ থেকে মুসলমান ওস্তাগর,দর্জিরা জামাকাপড় নিয়ে হাওড়ায় ব্যবসা করতে আসতে পারেন।
তিনি কালীঘাট গঙ্গাতে ঘাট, নিমতলা শ্মশান এবং ঘাট, আহিরীটোলা ঘাট, মেটিয়াবুরুজে দবীরগঞ্জের কবরস্থান, ইম্পিরিয়াল লাইব্রেরী,হিন্দু কলেজ(এখনকার প্রেসিডেন্সী কলেজ ও ইউনিভার্সিটি), বেলেঘাটা বাজার,ভবানীপুরের বাজার, সালকিয়াতে হরগঞ্জ বাজার,চাঁদনিচকের বাজার, প্রভৃতি।
রাণী রাসমণির অনন্য কীর্তি হলো দক্ষিণেশ্বরের মা ভবতারিণীর মন্দির প্রতিষ্ঠা এবং তার পাশে মুসলমানদের দরগা,আর কুটিঘাটের কাছে খ্রিস্টানদের চার্চের পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা,এবং শিখ সন্তগুরু নানকের অবস্থানের স্মৃতিতে প্রথম গুরুদ্বারের সংস্করণ করা,ইত্যাদি, ইত্যাদি।
দক্ষিণেশ্বরের মা ভবতারিণীদেবীর মন্দিরেই আধুনিক মানব সভ্যতার যুগাবতার শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের জাগতিক লীলার এক অপার, অলৌকিক ক্ষেত্র সৃষ্টি হয়েছিল। যা আজ সারা বিশ্বে সর্বজনবিদিত, সবার কাছে এক পরম তীর্থভুমি।শুধু তাই নয়, পাশের মসজিদে এবং কুটিঘাটের চার্চে পরমপুরুষ শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংস দেব-এর ইসলাম এবং খ্রিস্টান ধর্মের সাধনায় নিজেকে বিলীন করে দেওয়ার এক অনির্বচনীয় সর্ব ধর্ম সমন্বয়ের বাস্তব ইতিহাস। যা আজকের যুগেও অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। সেই অনুভব থেকেই তিনি বলেছিলেন “যত মত,তত পথ…”।
শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংস দেব-এর সামগ্রিক লীলাময় কীর্তিতে রাণী রাসমণি ছিলেন এক অনন্য স্নেহময়তার আবরণে এক সাধিকার, আরাধিকার,স্নেহময়ী জননী রূপে। তিনি সান্নিধ্য লাভ করেছিলেন শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংস দেবের। কামারপুকুরের গদাধর চট্টোপাধ্যায় তথা রাণীমা অতি স্নেহের “ছোট ভটচায্” ভাবীকালের শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব- মহামহিম অলৌকিক যুগান্তকারী লীলা ক্ষেত্র তৈরী করতে পারতেন কি,যদি না তাঁকে রাণী রাসমণি দেবী দুর্গারমতো দশভুজার মতো তাঁকে সবদিক থেকে আগলে না রাখতেন।
শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংস দেব রাণী রাসমণি দেবীকে বলতেন “মা ভবতারিনীর অষ্ট সখীর প্রধান সখী…”।
রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন ” রাণী রাসমণি দেবী হলেন লোকমাতা…”। শ্রীমা সারদা বলতেন.. “আমার বড়ো মা ঠাকুরণ শাশুড়ী…. “।
স্বামী বিবেকানন্দ রাণী রাসমণিকে বলতেন.. “জগন্মাতা জগদ্ধাত্রী দেবী মা…”। ঋষি অরবিন্দ বলেছিলেন… ” রাণী রাসমণি দেবী হলেন এই যুগের মানব কল্যানের স্নেহময়ী জগজ্জননী…।” ভগিনী নিবেদিতা বলেছিলেন…” রাণী রাসমণি দেবী হলেন শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংস দেব-এর সাধনা এবং লৌকিক-অলৌকিক মাহাত্ম্যের শৈশব থেকে পূর্ণতাপ্রাপ্ত অবধি লীলাধাত্রী জননী। “
সেই যুগের এবং পরবর্তীকালের সকল মণিষীরাই রাণী রাসমণি দেবীকে মাতৃজ্ঞানে শ্রদ্ধা করে গেছেন। আজও তিনি বাংলা তথা ভারতবর্ষের অন্তঃস্থলে জননীর মতো প্রতিষ্ঠিতা।
রবীন্দ্রনাথ, স্বামী বিবেকানন্দ, ভগিনী নিবেদিতা, শ্রীঅরবিন্দ, প্রমুখরা তখনও জন্মগ্রহণ করেননি,…রাণী রাসমণি চলে গেলেন মহাপ্রস্থানের পথে।নশ্বর শরীর ত্যাগ করে অবিনশ্বর ঈশ্বরেরই সাথে একাত্মতায় মিলিয়ে গেলেন তিনি ১৮৬১ সালের আজকের দিনে, ১৯ ফেব্রুয়ারি।
আজ এই পবিত্র দিনে তাঁর পদপ্রান্তে রেখে গেলাম আমাদের আন্তরিক শ্রদ্ধা এবং প্রণাম।