প্রথম পাতা প্রবন্ধ সত্যিই গোবরেও পদ্মফুল ফোটে! “গোবর গোহ” এক বিস্মৃত বিস্ময়

সত্যিই গোবরেও পদ্মফুল ফোটে! “গোবর গোহ” এক বিস্মৃত বিস্ময়

1.3K views
A+A-
Reset

পঙ্কজ চট্টোপাধ্যায়

একটা অনেক পুরাতন কথা আছে..খেলা ধুলায় শরীর, মন, চরিত্র গঠন হয়। কিন্তু হায় আজকের অতি আধুনিক কালে আমরা আমাদের জীবন থেকে এই খেলাধুলাকে বিস্মৃতির অতলে ভাসিয়ে দিয়েছি। তাই বোধহয় ভুলে গেছি এই বাংলার, এই ভারতের, এমনকি এই উপমহাদেশের প্রথম কুস্তি বা রেসলিং-এ বিশ্বচ্যাম্পিয়ন “গোবর গোহ”-র কথা। ইংরেজদের পাল্লায় পড়ে বাঙালির ” গুহ” পদবী হয়ে গিয়েছিল “গোহ”। এই মাসেই সেই বিখ্যাত মানুষের জন্ম। তাই আজকের এই প্রতিবেদন।

১৮৯২ সালের ১৩ই মার্চ উত্তর কলকাতায় বিখ্যাত কুস্তির আখড়ার মালিক অম্বিকাচরণ গুহের ছেলে রামচরণ গুহের ঘরে দোলের দিন ঘর আলো করে জন্ম নিল এক বিস্ময়কর শিশু। মায়ের নাম কাত্যায়নী দেবী।
বেশ নাদুসনুদুস দেখতে হয়েছিল বলেই দাদু, ঠাকুমা আদর করে ডাকতে শুরু করেন গোবর বলে।
তখনকার দিনে অম্বিকাচরণদের কুস্তির আখড়াতে কুস্তি করতে আসতেন স্বামী বিবেকানন্দ, ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায়, স্বামী ব্রহ্মানন্দ, প্রমুখরা।

গোবর গুহের আসল নাম ছিল যতীন্দ্রচরন গুহ। কলকাতার মেট্রোপলিটন স্কুলে পড়াশোনার পাশাপাশি কুস্তির তালিমও শুরু হয় গোবরের। প্রথমে কাকা ক্ষেত্রচরণ গুহের কাছে,তারপরে খোসলা চৌবে,এবং রহমানি পালোয়ানির কাছে তিনি কুস্তির তালিম নেন।

ব্যায়ামবিদ ও কুস্তিগীর গোবর গুহের শরীর ছিল এক মন্দির। ওজন ছিল ১১১ কিলোগ্রাম। গলা ছিল ২০ ইঞ্চি,হাতের গোছ ছিল ১৫/১৬ ইঞ্চি, কবজি ছিল পৌনে ৯ ইঞ্চি, বুকের ছাতি ছিল ৫৮ ইঞ্চি, ফোলালে ৬০/৬২ ইঞ্চি, উরু ছিল ৩৩ ইঞ্চি, পায়ের ডিম ছিল সাড়ে ১৮/১৯ ইঞ্চি, গোবর গুহের মুগুরের ওজন ছিল ২৫ সের, পায়ের শক্তি বাড়ানোর জন্য ১৫ মন ওজনের পাথরের নেক্ কলার পড়তেন তিনি।

জামাইবাবু শরৎচন্দ্র মিত্রের কথায় তিনি কুস্তি লড়তে বিদেশে যান। ১৯১০ সালে মাত্র ১৮ বছর বয়সে বড়ো গামা,আহমেদ বক্স,ইমাম বক্স প্রমুখদের হারিয়ে ইংল্যান্ড যাত্রা করেন। স্বামী বিবেকানন্দ ছিলেন গোবর গুহের অনুপ্রেরণা। প্রাণের মানুষ ছিলেন রবীন্দ্রনাথ।প্রিয় মানুষ ছিলেন নেতাজী সুভাসচন্দ্র বসু।

১৯১৩ সালের আগস্টে এডিনবরায় স্কটিশ চ্যাম্পিয়ন জিমি ক্যাম্বেলকে ১ঘণ্টা ৫ মিনিটে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হন।তারপরে লণ্ডনে জিমি এসন্-কে হারিয়ে ব্রিটিশ চ্যাম্পিয়ন হন। কিন্তু রেসলিং-এ চ্যাম্পিয়নের প্রাপ্য ” জন্ বুল্ বেল্ট্” তাকে দেওয়া হয়নি, কারন তিনি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের প্রজা ছিলেন, জন্মসূত্রে ব্রিটিশ ছিলেন না, তাই।
ওই বছরেই ফ্রান্সের প্যারিসে বেলজিয়ামের হ্যানসন, জার্মানির কারল্ জাফট্-কেও হারিয়ে তিনি ফ্রেঞ্চ চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলেন।

১৯২১ সালে আমেরিকার সানফ্রান্সিসকোতে রেসলিং চ্যাম্পিয়ন এড স্যান্টাল্-কে হারিয়ে তিনি ইউ.এস.এ. চ্যাম্পিয়ন হন। তখন তিনি কুস্তিতে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হিসাবে প্রথম এশিয়ান, প্রথম ভারতীয়, প্রথম বাঙালি হিসাবেও বিশ্বখ্যাতি অর্জন করেন।

জর্জ বার্ণার্ড শ’, অস্কার ওয়াইল্ড এর ভক্ত ছিলেন তিনি।তিনি জাতিভেদ, সাম্প্রদায়িকতার,বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন।নিউইয়র্কে, লন্ডনে, প্যারিসে,বার্লিনে,ডাবলিনে, প্রভৃতি জায়গাতে স্বামী বিবেকানন্দ, রবীন্দ্রনাথের ওপরে বক্তৃতা করেছিলেন। ১৯১৯ সালে জালিয়ানওয়ালাবাগের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের তীব্র প্রতিবাদ করেছিলেন লন্ডনের একটি সভায়। তখন তিনি ইংল্যান্ডে।

ভারতে ফিরে এসে তিনি মসজিদবাড়ি স্ট্রিট এবং গোয়াবাগানে কুস্তির আখড়া করেন সেইখানে আসতেন যুবক বয়সের বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসু, কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত,মহাত্মা গান্ধীর সচিব অধ্যাপক নির্মল কুমার বসু সহ বহু বিপ্লবীরা।

গোবর গুহের মেজো ছেলের বন্ধু ছিলেন প্রখ্যাত সঙ্গীত শিল্পী মান্না দে(প্রবোধ দে),তিনিও গোবর গুহের কাছে কুস্তির তালিম নিয়েছিলেন।

গোবর গুহ খুব ভালো সেতার বাজাতে পারতেন। তিনি মনে প্রাণে ছিলেন একজন সাচ্চা মানুষ,একজন দেশপ্রেমিক। তাঁর আখড়া ছিল স্বদেশী আন্দোলনের বিপ্লবীদের গোপন আস্তানা। সেখানে নিয়মিতভাবে যেতেন বাঘা যতীন, নেতাজী সুভাসচন্দ্র, বারীন্দ্রনাথ ঘোষ, প্রমুখরা।

১৯৭২ সালের ২রা জানুয়ারী তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

আমরা বাঙালিরা, আমরা ভারতীয়রা ভীষণ আত্মবিস্মৃত জাতি, তাই এমন এক প্রথিতযশা মানুষকে আমরা মনেই রাখিনি। এটা আমাদের অপদার্থতা,অক্ষমতা, লজ্জার বিষয়। আমরা এই মহান ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্বকে জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা এবং প্রণাম।

মন্তব্য করুন

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.