পঙ্কজ চট্টোপাধ্যায়
সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ছোটভাই পূর্ণচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এবং অপর ভাই শচীশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের লেখায় জানা যায়, বঙ্কিমচন্দ্র সম্পাদিত বাংলা মাসিক পত্রিকা ‘বঙ্গদর্শন’-এর জন্য এক সময় কিছু লেখা কম পড়েছিল। পত্রিকার কয়েকটি পৃষ্ঠা পূরণ করার জন্য নতুন লেখার প্রয়োজন দেখা দেয়।
এই কারণে ১৮৭৫ সালের অক্টোবর মাসের শেষদিকে এক সকালে ‘বঙ্গদর্শন’-এর সহ-মুদ্রাকর পণ্ডিত রামচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় বঙ্কিমচন্দ্রের বাড়িতে যান। তখন বঙ্কিমচন্দ্র অফিসে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। রামচন্দ্রবাবু তাঁকে অনুরোধ করেন—পত্রিকার পেজ মেকআপের জন্য যদি কোনও নতুন লেখা থাকে, তা দিতে।
এর উত্তরে বঙ্কিমচন্দ্র বলেন, রামবাবু যেন পরে আসেন, কারণ তিনি তখন অফিসে বেরোচ্ছেন। অগত্যা রামচন্দ্রবাবু ফিরে যেতে উদ্যত হলে হঠাৎ টেবিলের ওপর পেপারওয়েট দিয়ে চাপা দেওয়া একটি লেখা তাঁর চোখে পড়ে। কৌতূহলবশত তিনি লেখাটি তুলে নিয়ে পড়েন এবং বলেন—যদিও এটি বাংলা ও সংস্কৃত ভাষার মিশ্রণে লেখা একটি কবিতা, তবুও পত্রিকার পেজ মেকআপের জন্য এটি ব্যবহার করা যেতে পারে।
বঙ্কিমচন্দ্র জানান, লেখাটি সদ্য রচিত। তবু রামচন্দ্রবাবু বলেন—এতেই চলবে। তখন বঙ্কিমচন্দ্র কথার ছলে বলেছিলেন,
“আরে মশাই, দেখবেন—এই লেখাই একদিন এই দেশকে মাতাবে।”
ঠিক সেই লেখাটিই ১৮৭৫ সালের ৭ নভেম্বর ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। সেই লেখার নাম—‘বন্দেমাতরম’।
পরবর্তীতে ১৮৮১ সালের ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকার মার্চ-এপ্রিল সংখ্যায় বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর উপন্যাস ‘আনন্দমঠ’-এর প্রথম কিস্তির সঙ্গে ‘বন্দেমাতরম’ কবিতাটি সংযুক্ত করেন।
এরপর ‘বন্দেমাতরম’ কবিতাটিতে সুর সংযোজন করা হয়। প্রথম সুরারোপ করেন বিষ্ণুপুর ঘরানার প্রখ্যাত সঙ্গীতাচার্য যদুনাথ ভট্টাচার্য (যিনি যদু ভট্ট নামে পরিচিত)। পরে ‘বন্দেমাতরম’-এর প্রথম দুটি স্তবকে সুর দেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। বাকি স্তবকগুলিতে সুর সংযোজন করেন রবীন্দ্রনাথের ভাগ্নী সরলা ঘোষাল, যিনি সরলা দেবী চৌধুরাণী নামে সুপরিচিত। এই তথ্য পাওয়া যায় সরলা দেবীর আত্মকথা ‘জীবনের ঝরাপাতা’ গ্রন্থে।
পরবর্তী কালে ‘বন্দেমাতরম’ গানটি সারা বাংলা তথা সমগ্র ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনের বিপ্লবী সন্তানদের অন্তরের উচ্চারণ হয়ে ওঠে। অগণিত শহীদের ফাঁসির মঞ্চে আত্মবলিদানের শেষ উচ্চারণ ছিল এই ‘বন্দেমাতরম’ ধ্বনি। ঘরে ঘরে, শহরে-নগরে, গ্রামে-গ্রামান্তরে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে মানুষ উচ্চারণ করতেন—বন্দেমাতরম।
আজও সেই ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা প্রতিটি ভারতবাসীর অন্তরে অমলিন। তাই বন্দেমাতরম ভারতবর্ষের আত্মার আত্মীয়, ভারতবাসীর অহংকারের অঙ্গীকার।
পরাধীন ভারতের দেশপ্রেমিক মানুষ দেশের ভিতরে ও দেশের বাইরে ‘বন্দেমাতরম’ ধ্বনি ও গানকে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হওয়ার প্রেরণা হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন।
১৯৩৭ সালে নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু ‘বন্দেমাতরম’ গানটিকে ভারতের জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে গ্রহণ করার প্রস্তাব দেন। পরে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৫০ সালে সরকারিভাবে ‘বন্দেমাতরম’ গানটিকে ভারতের জাতীয় গান হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়।
বন্দেমাতরম আজ আমাদের হৃদস্পন্দন। বন্দেমাতরম আমাদের এক ঐতিহাসিক ঐতিহ্য, এক অনন্যসাধারণ পরম্পরা।
এই গানটি ভারতের প্রায় সমস্ত ভাষায় অনূদিত হয়েছে। এমনকি ইংরেজি ও ফরাসি ভাষাতেও অনুবাদ হয়েছে।
‘বন্দেমাতরম’ শব্দবন্ধের অর্থ—“মা, তোমাকে বন্দনা করি।”
এই মা আমাদের জননী জন্মভূমি, দেশমাতৃকা। সেই মায়ের বন্দনাই আমাদের জীবনের পাথেয়।