সঙ্গীতা চৌধুরী: রিলায়্যান্স গোষ্ঠীর তত্ত্বাবধানে সংস্কারের কাজ চলছে দু’শতাব্দী প্রাচীন কালীঘাট মন্দিরের। এই প্রাচীনতম মন্দিরকে আধুনিকতার ছোঁয়ায় নতুনভাবে সাজানোর কাজ পুরোদমে চলছে। কলকাতা পুরসভার উদ্যোগে কাজ শুরু হয়েছিল ২০১৯ সালের আগস্ট মাসে। কিন্তু ২০২০ সালের মার্চ মাস থেকে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণের প্রকোপে দীর্ঘদিন কাজ বন্ধ রাখতে হয়। তারপর কালীঘাট মন্দির চত্বর থেকে দোকান সরাতেও পুরসভাকে খুবই সমস্যার মধ্যে পড়তে হয়। এছাড়াও বারো মাসে তেরো পার্বনের ফলে মাঝে মাঝে মন্দিরে এত বেশি ভক্তের আগমন ঘটে তখন কাজ বন্ধ রাখতে হয়, এসব নানা কারনে দীর্ঘদিন ধরে কাজ ঠিকমত এগোয়নি। পুরসভার কাজের এই মন্থর গতি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর নজরে এলে তিনি অসন্তোষ প্রকাশ করেন। এবং তারপরই মুকেশ আম্বানির মালিকানাধীন রিলায়্যান্স গোষ্ঠীর হাতে কাজের দায়িত্ব তুলে দেন।
মন্দির কমিটির তরফ থেকে জানা যায়, মন্দিরের যাতায়াতের পথ ও অন্যান্য জায়গা সংস্কার হবে। ভক্তদের জন্য নানা রকম পরিষেবার ব্যবস্থা থাকবে। তাছাড়া মূল মন্দির, গর্ভগৃহ, ভোগঘর, নাটমন্দির, শিবমন্দির, কুন্ডপুকুর, মন্দিরের চাতালসহ ভিতরে ও বাইরের দেওয়াল, বলির স্থান সহ গোটা মন্দির চত্বর সংস্কার হবে। মন্দিরের ঐতিহ্য বজায় রেখেই কাজ হবে। প্রচুর সিসিটিভি ক্যামেরা বসবে। তবে যেহেতু মা কালীর গর্ভগৃহ, ভোগঘর, নাটমন্দির, শিবমন্দির স্থানগুলো গ্রেড ‘এ’ হেরিটেজের মধ্যে পড়ে তাই সংস্কারের জন্য এ ক্ষেত্রে কলকাতা পুরসভার হেরিটেজ কমিটি ও হেরিটেজ কমিশনের অনুমতি নেওয়া হয়েছে।
কালীঘাট মন্দির একটি প্রাচীন এবং অন্যতম বিখ্যাত শক্তিপীঠ। এটি একান্ন শক্তিপীঠের অন্যতম হিন্দু তীর্থক্ষেত্র। এই তীর্থের পীঠদেবী দক্ষিণাকালী। পৌরাণিক কিংবদন্তি অনুসারে, সতীর দেহত্যাগের পর তাঁর ডান পায়ের চারটি (মতান্তরে একটি) আঙুল এই তীর্থে পতিত হয়েছিল। পুরান মতে এ স্থান বারাণসী তুল্য। বিখ্যাত কালীঘাট কালী মন্দিরটি কালীঘাটে অবস্থিত। সারা দেশের দর্শনার্থীদের জন্য মন্দিরটি আকর্ষণীয়। স্নান যাত্রার সময়, পুরোহিতরা তাদের চোখ ঢেকে দেবীকে স্নান করান। দীপাবলিতে, কালী পুজোও এখানে উৎসাহ ও ভক্তি সহকারে করা হয়। কালীঘাট একটি বহু প্রাচীন কালীক্ষেত্র। গবেষকদের মতে, ” কালীক্ষেত্র ” বা ” কালীঘাট ” কথাটি থেকে ” কলকাতা ” নামটির উদ্ভব। মনে করা হয় প্রায় ২০০০ বছর আগের গ্রীক দার্শনিক টলেমির ভারত বর্ননাতে যে কালীগ্রামের কথা রয়েছে সেটিই আজকের কালীঘাট। এও জানা যায় যে ১১০০ খ্রিস্টাব্দে রচিত চন্ডীমঙ্গলে বর্নিত ধনপতি সওদাগর তার পুত্র শ্রীমন্তকে নিয়ে সপ্ত ডিঙায় চরে আদিগঙ্গা দিয়ে যাবার সময় এখানে পুজো দিয়েছিলেন।
কথিত আছে আত্মারাম ব্রক্ষ্মচারী নামে একজন মাতৃসাধক একসময় এখানে কালীর ধ্যান করেছিলেন। এরপর এক রাতে তিনি দেবীর কন্ঠস্বর শুনতে পান। যে বেদীতে বসে তিনি ধ্যান করেছিলেন তা ব্রক্ষ্মবেদী নামে পরিচিত। আর দেবীর অবস্থান ছিল সেই পাশের কালীন্দি হ্রদে। আত্মারাম ব্রক্ষ্মচারীকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল যে, নীলগিরি পর্বতে ব্রক্ষ্মনন্দ গিরী নামে একজন সাধক আছেন, তার কাছে যে কষ্টিপাথরের শিলাস্তম্ভ রয়েছে, তা যেন সেই ব্রক্ষ্মবেদীতে স্থাপন করা হয়। এরপর আত্মারাম নির্দেশ মত নীলগিরি গিয়ে ব্রক্ষ্মানন্দের সঙ্গে দেখা করেন। এবং মনে করা হয় কোন দৈববলে ১২ হাত লম্বা আর ২ হাত চওড়া সেই শিলাকে কালীঘাটে আনা হয়েছিল। জানা যায় এরপর স্বয়ং দেবশিল্পী বিশ্বকর্মা সেখানে আবির্ভূত হয়ে সেই শিলাকে মাতৃরূপ দেন আর তা ব্রক্ষ্মবেদীতে স্থাপন করেন। এভাবে দেবীর স্থাপন হলেও তখনও দেবীর সেই খণ্ডিত চরণ নিখোঁজ ছিল। এই সময় এক রাতে কালীন্দি হ্রদের পাশে আত্মারাম ও ব্রক্ষ্মনন্দ সাধনার সময় হ্রদের ভেতরের একটি স্থানে আলো দেখতে পান। পরদিন ভোরে তারা সেখানে মায়ের চরণাংশ পান। সেই দিনটি ছিল স্নানযাত্রার দিন। জৈষ্ঠ্য মাসের এই বিশেষ দিনটি আজও প্রথা মেনে বিশেষ পুজো হয়। ১৮০৯ সালে বড়িষার সাবর্ন জমিদার শিবদাস চৌধুরী, তাঁর পুত্র রামলাল ও ভ্রাতুষ্পুত্র লক্ষীকান্তের উদ্যোগে আদিগঙ্গার তীরে বর্তমান মন্দিরটি স্থাপিত হয়। পরবর্তীকালে মন্দিরের কিছু অংশের সংস্কার করেন সন্তোষ রায়চৌধুরী।
তবে আবারও সংস্কারের প্রয়োজনেই বর্তমান উদ্যোগ। এ ব্যাপারে মন্দির কমিটির অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি ইন্দ্র দাস ব্যানার্জী জানান, ” মন্দিরের কাজ পুরোপুরি শেষ হতে নভেম্বরের শেষ সপ্তাহ বা ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহ হয়ে যেতে পারে, তেমনটাই রিলায়্যান্স গোষ্ঠী আমাদের জানিয়েছে। দীর্ঘ অপেক্ষার পর যে একটা সুন্দর ঝকঝকে পরিবেশ উপহার পাব সেই আশাতেই রয়েছি। তবে মন্দির চত্বরটাও এখন আগের থেকে অনেকটাই প্রশস্ত হচ্ছে কারন এখন আর মন্দিরের ভেতরের পুজোর সামগ্রী কেনার বিপনীগুলো থাকছে না। ভক্তরা একটা খোলামেলা পরিবেশ পাবে। তবে যতই জায়গা থাক আমাদের দেশে হুড়োহুড়ি করাটা কিছু মানুষের একটা প্রবনতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই আশা করবো দর্শনার্থীরা সচেতন ভাবে মন্দিরের পরিচ্ছন্নতা বজায় রেখে একটা সুস্থ পরিবেশের মধ্যে মাকে দর্শন করার চেষ্টা করবেন।”
সারা বিশ্বের মানুষের কাছে কলকাতার একটি অন্যতম দর্শনীয় স্থান হল কালীঘাট। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে আশা করা যাচ্ছে নতুন বছরে একটু অন্যরকম ভাবে কালীঘাট মন্দিরে মাকে দর্শন করা যাবে।