প্রথম পাতা খবর পঞ্চাশে সত্যজিতের জন অরণ্য: মূল্যবোধের সংকটের কাহিনি আজও প্রাসঙ্গিক

পঞ্চাশে সত্যজিতের জন অরণ্য: মূল্যবোধের সংকটের কাহিনি আজও প্রাসঙ্গিক

136 views
A+A-
Reset

পঙ্কজ চট্টোপাধ্যায়

সত্যজিৎ রায়ের জন অরণ্য পঞ্চাশে পদার্পণ করল ২০২৫ সালে।

১৯৪৭-এ দেশীয় নেতানেত্রীদের অপরিণামদর্শিতা, স্বার্থপরতা, আর তার সঙ্গে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শক্তির নিরবিচ্ছিন্ন গভীর ষড়যন্ত্রের কারণে খণ্ডিত হয়েছিল অখণ্ড ভারতবর্ষ। তার প্রভাব পড়েছিল পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক—সহ সমাজের প্রায় সবক্ষেত্রেই। সেই ভাঙনকালের অন্তর্নিহিত স্পন্দন স্পর্শ করেছিলেন সাহিত্যিক মণিশঙ্কর মুখোপাধ্যায় (শংকর)-এর কাহিনির ভিত্তিতে নির্মিত এই জন অরণ্য চলচ্চিত্রে সত্যজিৎ রায়।

চারিদিকে এক বিচ্ছিন্নতা, আমি-সর্বস্বতা চরম রূপ নিয়েছিল। দেশের অন্যান্য প্রদেশের মতো বাংলাতেও তার অভিঘাত ছিল প্রবল। সেই বাস্তবতা তিনি তুলে ধরেছিলেন সত্তরের দশকের গোড়ায় প্রতিদ্বন্দ্বী এবং সীমাবদ্ধ ছবিতে। তারও আগে, ষাটের দশকের গোড়ায় নগরমুখী যে বিচ্ছিন্নতার জন্ম হয়েছিল বা সমাজ যে বিভাজন তৈরি করেছিল, তা আমরা দেখি মা সর্বজয়া এবং সন্তান অপুর মধ্যে। আর তারই চূড়ান্ত সম্প্রসারণ ধরা পড়ে জন অরণ্য-তে—চাকরি না পাওয়া, অর্ডার সাপ্লাইয়ের কাজে হাসিমুখে যুক্ত হওয়া যুবক সোমনাথ এবং তার পুরোনো মূল্যবোধে বিশ্বাসী প্রবীণ পিতার মধ্যে দূরত্বে।

সোমনাথ দিনের শেষে বাড়ি ফেরে, লোডশেডিং চলছে। সেই দিনই সে ক্লায়েন্ট কোম্পানির অফিসারের কাছে অর্ডারের আশায় উপঢৌকন হিসেবে প্রায় না জেনেই পৌঁছে দিয়েছে তার বেকার দরিদ্র বন্ধুর বোনকে। একরাশ ক্ষমাহীন অপরাধবোধ তার মনে গভীর অন্ধকারের জন্ম দেয়। সিনেমার পর্দা জুড়ে সেই অন্ধকার আমাদেরও টেনে নিয়ে যায় বিবেকের সামনে। অন্ধকারে বসে থাকে একা সোমনাথ। বসে থাকি আমরাও। বিষণ্ণ, ক্লান্ত বৃদ্ধ বাবা শুনছেন রবীন্দ্রনাথের গান—“ছায়া ঘনাইছে…”

মূল্যবোধের এই সঙ্কট শুরু হয়েছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে, প্রকটতা বেড়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়, আর ১৯৪৭-এর অনভিপ্রেত পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে তা আরও বিস্তার লাভ করে। ষাটের দশকে কমিউনিজম যখন তার আদি বিশুদ্ধ চেহারা হারাতে শুরু করল, তখন সমাজে জন্ম নিল দিশাহারা দ্বান্দ্বিকতা। বাঙালি মধ্যবিত্ত ভেতরে ভেতরে বদলাতে লাগল। তার উদার মানবিকতা আবছা হতে থাকল জটিল সামাজিক-রাজনৈতিক কুয়াশার ধোঁয়াশায়। এক বিভৎস গোলকধাঁধায় আটকে গেল মানুষ।
এই পরিবর্তন সত্যজিতের চোখ এড়ায়নি। তিনি এর মুখোমুখি হয়েছেন, মুখ ফিরিয়ে থাকতে পারেননি।

জন অরণ্য-র সোমনাথ ব্যবসা করতে গিয়ে বুঝল, তাকে নারীসঙ্গ জোগাতে হবে কোম্পানির অফিসারদের, নিতে হবে অসৎ পন্থার আশ্রয়, লড়তে হবে নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে। সে উপলব্ধি করল, সে ঢুকে পড়েছে এক অরণ্যে, যেখান থেকে ফেরার পথ তার অজানা। সমাজের গায়ে লেগে গেছে এক তকমা—‘দালালি’। কবি শঙ্খ ঘোষ লিখেছিলেন—“সত্যজিৎ রায়ের জন অরণ্য থেকে বেরিয়ে আসি মাথা নীচু করে। ভয় হয়, আমাদের তিনি এবার দেখে ফেলেছেন পুরোপুরি।”

পঞ্চাশ বছর পরেও আমাদের রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় সেই ছায়াময়তা রয়েই গেছে, বরং বেড়েছে। আমরা স্থবিরতায়, মেরুদণ্ডহীনতায় মেনে নিয়েছি প্রায় সবকিছু। আমাদের সমস্ত বারুদ জমা হয়ে আছে দেশলাইকাঠির মুন্ডিতে। মোমবাতির আগুনে যে তেজস্বী শিখা জ্বলে, তা দিয়ে বড়জোর একটা সিগারেট ধরাই। সোমনাথও সেদিন তাই করেছিল।

আজ, পঞ্চাশ বছর পরেও জন অরণ্য-র অসহায়তার সেই ঘনিয়ে ওঠা ছায়া রয়েই গেছে জনারণ্যে।
এখানেই জন অরণ্য-র সার্থকতা।

আরও খবর

মন্তব্য করুন

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.