প্রথম পাতা খবর “ও আলোর পথযাত্রী, এ যে রাত্রি, এখানে থেমো না…”

“ও আলোর পথযাত্রী, এ যে রাত্রি, এখানে থেমো না…”

193 views
A+A-
Reset

পঙ্কজ চট্টোপাধ্যায়

সেই আলোর পথযাত্রীর জন্মশতবর্ষ পায়ে পায়ে এগিয়ে এসেছে ২০২৪-এর ১৯ নভেম্বরের দোরগোড়ায়। অনন্যসাধারণ সঙ্গীত শিল্পী এবং চিরভাস্বর সঙ্গীতপ্রতীভা সলিল চৌধুরী ১৯২৫ সালের ১৯ নভেম্বর জন্মগ্রহণ করেছিলেন। আর চলে গেলেন ১৯৯৫ সালের ৫ সেপ্টেম্বর।

শুধু বাংলা ভাষায় নয়,সলিল চৌধুরীর সুরারোপিত গান রয়েছে হিন্দি,মালয়ালাম,ওড়িয়া,অসমীয়া,তামিল,তেলুগু,মারাঠি,গুজরাটি,কন্নড়, প্রভৃতি ভাষাতেও বিভিন্ন চলচ্চিত্রে। আসামে লতাবাড়িতে সলিল বাবার বাড়িতে ছোটবেলাতেই বাবা ডাক্তার জ্ঞানেন্দ্রময় চৌধুরীর গানের প্রতি অনুরাগের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। পরিচিত হয়েছেন সেখানকার চা-বাগানের শ্রমিক মজদুরদের গানের পাশাপাশি বাড়িতে এদেশীয়,বিদেশীয় সঙ্গীতের সাথে। তারপর দাদা নিখিল চৌধুরীর কাছে গানের ব্যাপারে আরও অনুপ্রেরণা তিনি পেয়েছিলেন।

১৯৪৪ সালে পড়াশোনা করতে কলকাতায় চলে আসেন।এখানে তিনি ভারতীয় গণনাট্য সংঘের সাথে ওতোপ্রোতোভাবে যুক্ত হন। তারপর শুরু হোল একের পর এক কালজয়ী গান তৈরীর ইতিহাস।

“সঙ্গীত চিন্তা” গ্রন্থে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন,- “সঙ্গীতে এতখানি প্রাণ থাকা চাই,যাহাতে সে সমাজের বয়সের সহিত বাড়িতে থাকে,সমাজের পরিবর্তনের সহিত পরিবর্তিত হইতে থাকে,সমাজের উপর নিজের প্রভাব বিস্তৃত করিতে পারে ও তাহার উপর সমাজের প্রভাব প্রযুক্ত হয়।” সলিল চৌধুরীর সঙ্গীত রচনার মধ্যে সেই প্রাণশক্তি এসে পৌঁছেছিল জনতার ঢেউয়ে ঢেউয়ে ভেসে।

একের পর এক কালজয়ী সৃষ্টি –কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য-এর “রানার”, “ঠিকানা”, ” অবাক পৃথিবী”, কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের “পাল্কীর গান”, ” ছিপ খান তিন দাঁড়”, সলিলের নিজের লেখা ” কোনো এক গাঁয়ের বধু..”, ” বিচারপতি তোমার বিচার করবে যারা,আজ জেগেছে সেই জনতা”, “হেঁই সামাল হো..”, ” ও মোদের দেশবাসীরে…”, ” ও আলোর পথযাত্রী..”,ইত্যাদি ইত্যাদি।

মানুষের সীমাহীন বঞ্চনা,অন্যায় অবিচার, অপমান,এবং তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদের গানই হোল সলিল চৌধুরীর গান।

হিন্দি চলচ্চিত্রের বহু কালজয়ী গান সলিলের রচনা। যা আজও মানুষের মুখে মুখে ঘুরে বেড়ায়।

সলিল গান তৈরী করছেন সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে– “ধন্য আমি জন্মেছি মা তোমার ধুলিতে”… যে গানের অন্তরাতে তিনি বলছেন– ” তোমারই সন্তান মোরা তোমারই সন্তান/ তুচ্ছ বিভেদ বিষে কত হয়েছি হয়রান / তখন/ দেখিনি মা ঘরে ঘরে কেঁদে কাটাও কাল/ আর/ গোপনে মরণে কাটে সর।সর্বনাশের খাল।” এই গান অবিসংবাদিতভাবে দেশপ্রেমের গান।

আজও প্রাসঙ্গিক তাই সলিলের গান। আজ সলিল চৌধুরীর জন্মশতবার্ষিকীতে তাঁর সৃষ্ট গানগুলি এখনও আমাদের প্রাণে,চেতনায় আহ্বান জানায়,আমাদের সাবধান করে দেয়,আমাদের সতর্ক করে দেয়,–” ও আলোর পথযাত্রী,এ যে রাত্রী, এখানে থেমো না…”
তিনিই আহ্বান জানান-“আহ্বান, শোন আহ্বান,/আসে মাঠ ঘাট বন পেরিয়ে,/ দুস্তর বাধা প্রস্তর ঠেলে বন্যার মতো বেরিয়ে,/…যুগ সঞ্চিত সুপ্তি দিয়েছে সাড়া,/ হিমগিরি শুনলো কি সূর্যের ইশারা/ যাত্রা শুরু উচ্ছ্বল রোলে,দুর্বার বেগে তটিনী..”।

সলিল চৌধুরী আমাদের বাংলা তথা ভারতবর্ষের সঙ্গীতের এক অনন্যসাধারণ উপন্যাস। যে উপন্যাসের পাতায় পাতায় মানুষের কথা, মানুষের ব্যথা,মানুষের প্রতিজ্ঞা,মানুষের প্রতিরোধ,বিদ্যমান। সলিলের গানে তাই উচ্চারিত হয়- “আমার প্রতিবাদের ভাষা,আমার প্রতিরোধের আগুণ/ দ্বিগুণ জ্বলে/ যেন,দারুন প্রতিশোধে,/ করে চূর্ণ, ছিন্নভিন্ন শত ষড়যন্ত্রের জাল,যেন আনে মুক্তি, আলো আনে,আনে লক্ষ্য শত প্রাণে….”

আসলে সলিল চৌধুরী আমাদের বাংলা তথা ভারতবর্ষের সঙ্গীতের এক ঐতিহাসিক বাস্তবতা। যে বাস্তবতার রেষ থেকে যাবে শতবর্ষ পেরিয়ে আরও শতবছরের দিকে,চিরন্তন শাশ্বত সত্য হয়ে।

জন্মশতবর্ষ যাপনে রইল সলিল চৌধুরীর প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা এবং কৃতজ্ঞতা।

আরও খবর

মন্তব্য করুন

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.