ইমনকল্যাণ সেন
এসআইআর নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বনগাঁ–ঠাকুরনগর পদযাত্রা মঙ্গলবার যেভাবে রূপ নিল, সেখানে সবচেয়ে চোখে পড়ার মতো বিষয় ছিল মহিলাদের অস্বাভাবিক, বলা যায় অভূতপূর্ব উপস্থিতি। বাড়ির ছাদ, দোকানের সামনে, রাস্তার ধারে—যেদিকে চোখ যায় শুধু নারীদের ঢল। সন্তানের হাত ধরে, কোলে বাচ্চা নিয়ে, কেউ আবার সকাল থেকে খাওয়া না করেই—সকলেই দাঁড়িয়ে মুখ্যমন্ত্রীকে একঝলক দেখার অপেক্ষায়। এই দৃশ্য কেবল ভিড়ের ছবি নয়; বরং মতুয়া সমাজের অভ্যন্তরে রাজনীতিকে কেন্দ্র করে নারীর মানসিক অবস্থান ও অংশগ্রহণের এক বড় পরিবর্তনের ইঙ্গিত।
মতুয়া সমাজের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে গৃহস্থালির মহিলাদের ভূমিকা বরাবরই গুরুত্বপূর্ণ। পরিবারের পরিচয়, নথি, ভোটার তালিকা—এসব বিষয় নিয়ে তাঁদের উদ্বেগ অনেক বেশি। তাই যখন মুখ্যমন্ত্রী এসআইআর নিয়ে বনগাঁর সভামঞ্চে কড়া সুরে প্রতিবাদ শুরু করেন, সে সুরের প্রতিধ্বনি সবচেয়ে বেশি শোনা গেল নারীমহলে। এলাকাবাসী প্রমীলা সাহা বলেন, ‘‘খাওয়াদাওয়া সেরে ভোরেই চলে এসেছি। দিদি আমাদের জন্য যেভাবে লড়ছেন, সেটা কাছে থেকে দেখতে চেয়েছি।’’ আরেক গৃহবধূ সোনালি দাসের বক্তব্য আরও রাজনৈতিক—‘‘এসআইআরে মতুয়াদেরই সবচেয়ে ভয়। দিদিই আমাদের ভরসা। তাই আমরা সবাই এসেছি।’’

এই মন্তব্যগুলি দেখায়, এসআইআর প্রশ্নে নারীরা শুধু দর্শক নন, তাঁরা সরাসরি আন্দোলনের অংশ। তাঁদের দৃষ্টিতে এসআইআর আর প্রশাসনিক প্রক্রিয়া নয়—এটি পরিচয়, নিরাপত্তা, পরিবার-ভবিষ্যৎ এবং রাজনৈতিক ভরসার প্রশ্ন। আর এই জায়গাটাই মুখ্যমন্ত্রী গভীরভাবে বুঝেছেন। ফলে তাঁর পদযাত্রায় দেখা গেল ফুলবৃষ্টি, ব্যানার, ‘দিদি আমরা আছি’ স্লোগানে উচ্ছ্বাস—যার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন মহিলারাই।
মিছিল যেদিকে এগিয়েছে, সেদিকেই নারীদের অংশগ্রহণ আরও বেড়েছে। কেউ মমতার দিকে ফুল ছুড়ছেন, কেউ ব্যানারে লিখেছেন উন্নয়নের খতিয়ান, কেউ মোবাইলে মুহূর্ত বন্দি করছেন। এক গৃহবধূর কোলে ছোট্ট শিশুকে মুখ্যমন্ত্রী আদর করতেই পুরো পরিবেশ যেন আরও উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়ল। এটি দেখিয়ে দিল, বনগাঁর এই পদযাত্রায় আবেগের সবচেয়ে বড় স্তম্ভ ছিল নারীসমাজ।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এটি নিছক ভিড় নয়—এটি ‘‘নারী-শক্তি’’র প্রকাশ। তৃণমূল বরাবরই নারী-ভোটব্যাঙ্ককে মজবুত করেছে কন্যাশ্রী, রূপশ্রী, লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের মতো প্রকল্প দিয়ে। ফলে মহিলাদের সঙ্গে শাসকদলের আবেগগত সম্পর্ক আরও গভীর। তারই প্রতিফলন ঠাকুরনগরের রাস্তায়—যেখানে মহিলাদের উপস্থিতি কার্যত মিছিলের গতি ও সুর ঠিক করে দিয়েছে।
এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য যে বনগাঁ, ঠাকুরনগর ও গোটা মতুয়া অঞ্চল গত কয়েক বছর ধরে বিজেপির শক্ত ঘাঁটি হিসেবে বিবেচিত। কিন্তু মঙ্গলবারের মিছিলে নারীদের স্রোত দেখাল—নারী-সমর্থনের লড়াইয়ে তৃণমূল স্পষ্টভাবেই এগিয়ে যাচ্ছে। কারণ পরিবারে ভোটের সিদ্ধান্তে এখন অনেক সময় নারীরাই শেষ কথা বলেন। বিশেষ করে মতুয়া সমাজে, যেখানে নারীর সামাজিক ভূমিকা বহু ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয়।
এসব মিলিয়ে মঙ্গলবারের পদযাত্রা শুধুই মমতার প্রতিবাদ নয়; এটি ছিল এক বৃহৎ নারী-সমাবেশ, যা স্পষ্ট জানিয়ে দিল—এসআইআর ইস্যুতে সবচেয়ে সক্রিয় শক্তি হয়ে উঠছেন মহিলারাই। তারা বুঝতে পারছেন, পরিচয়ের প্রশ্ন তাঁদের জীবনে কীভাবে প্রভাব ফেলে। এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই তাঁরা রাস্তায় নেমে এসেছেন, স্লোগান তুলেছেন, মুখ্যমন্ত্রীর পাশে থাকার বার্তা দিয়েছেন।সুতরাং বনগাঁর এই ছবিটি রাজনীতির ভাষা স্পষ্ট করে দিল। নারী-উপস্থিতি দেখিয়ে দিল, রাজনৈতিক লড়াইয়ে নারীরা এখন সামনের সারিতে; তাঁরা মমতার প্রতিবাদকে সামনে থেকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রধান শক্তি। মতুয়া রাজনীতির ভবিষ্যৎ এবং এসআইআর বিতর্ক—দুটোতেই এই নারীর অংশগ্রহণ আগামী দিনে বড় প্রভাব ফেলবে। এই মিছিলের বার্তা তাই স্পষ্ট—প্রতিবাদ যখন নারীর কাঁধে ভর করে, তখন তা কেবল রাজনৈতিক হয় না; তা সামাজিক শক্তির সবচেয়ে বড় প্রকাশে রূপ নেয়।