পঙ্কজ চট্টোপাধ্যায়
রাখী নিয়ে অনেক কাহিনী আছে। পৌরাণিক লোককথা অনুযায়ী, দৈত্যরাজ বলি ছিলেন ভগবান বিষ্ণুর পরম ভক্ত। মহাপরাক্রমশালী বলিরাজা দেবতাদের পরাজিত করেন। তখন দেবতাদের অনুরোধে বিষ্ণু বামন অবতার রূপে আসেন বলিরাজের কাছে এবং ত্রিপাদ্ভূমি প্রার্থনা করেন। বামন অবতার দুটি পা ফেলেন একটি স্বর্গতে,আরেকটি মর্ত্যে। তৃতীয় পা ফেলার জন্যে বলিরাজা নিজের মাথায় পা রাখতে বলেন। এতে প্রসন্ন হয়ে ভগবান বলিকে আশীর্বাদ করে বলেন তিনি বলির ঘরেই বসবাস করবেন। ফলে বৈকুন্ঠ ছেড়ে চলে এলেন বিষ্ণু বলির রাজ্যে। ওদিকে বিষ্ণুপ্রিয়া দেবী লক্ষী বিষ্ণুকে ফিরে পেতে বলির রাজ্যে আসেন আর বলিকে তুষ্ট করে তার হাতে আর বিষ্ণুর হাতে এক শ্রাবণী পূর্ণিমার দিনে কাপড়ের খন্ড বেঁধে দেন তাদের অটুট বন্ধনের জন্যে,সুর আর অসুরের শুভ বন্ধন।আর্য আর অনার্যের মধ্যে শুভ বন্ধন। এটাই ইতিহাসের আদিকথা।
আবার ভাগবত পুরাণ অনুযায়ী কাহিনী হোল, বসুদেবের প্রথমা স্ত্রীর কোলে এই শ্রাবণী পূর্ণিমার দিনে জন্ম নেন ভগবান শ্রীকৃষ্ণ-এর অগ্রজ বলরাম।আর বসুদেবের দ্বিতীয় স্ত্রী দেবকীর কোলে জন্ম নেন ভাদ্র মাসের অষ্টমীতিথিতে স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ। আর তারা পালিত হয়েছিলেন যশোদার কাছে।যশোদা বলরাম শ্রীকৃষ্ণকে দুটি হাতে বস্ত্রখণ্ড দিয়ে একসাথে বেঁধে রাখতেন।
আরেকটি পৌরাণিক কাহিনি হোল,মহাভারতের যুগে শ্রীকৃষ্ণ শিশুপালকে বধ করেছিলেন শ্রীকৃষ্ণের সুদর্শন চক্রের দ্বারা। সেই সুদর্শন চক্র চালিত করতে গিয়ে শ্রীকৃষ্ণের ডান হাতের তর্জনী কেটে রক্তাক্ত হয়ে গিয়েছিল। ব্যাপারটি শ্রীকৃষ্ণের অন্যতমা সখী দ্রৌপদীর নজরে আসে এবং দ্রৌপদী তখন নিজের শাড়ির আঁচল ছিন্ন করে শ্রীকৃষ্ণের ক্ষতস্থানে বেঁধে দেন। অভিভুত হয়েছিলেন শ্রীকৃষ্ণ সেদিন। এটাও রাখীবন্ধনের এক প্রেক্ষাপট।
আর একটি ঐতিহাসিক কাহিনি আছে–সেটা হল,
৩২৬ খ্রিস্ট পূর্বাব্দে মহাবীর আলেক্সান্ডার পৃথিবী জয় করতে করতে ভারতবর্ষে আসেন।উপস্থিত হন পশ্চিম পাঞ্জাবের ঝিলাম নদীর উপকূলে। সেখানে মহাবলশালী মহারাজ পুরু-র সাম্রাজ্য। পুরু অপরাজেয় এক মহাবীর।এই কথা আগে থেকেই জানতে পারেন সম্রাট বীর আলেকজান্ডার-এর কাকার মেয়ে তথা অন্যতমা স্ত্রী আলেকজান্দ্রা রোজানা।তিনি পুরুর কাছে বটগাছের সরু শিকড়,যাকে ঝুরি বলে,সেই ঝুরিতে নিজের গলার একটি মালা বেঁধে ব্যক্তিগত দুতের মাধ্যমে অনুরোধ পাঠান,যে পুরু যেন দেখেন যে কোনভাবেই আলেকজান্ডারের কোনও ক্ষতি না হয়। আর এই ঘটনা কাকতালীয়ভাবে ঘটেছিল এক শ্রাবণী পূর্ণিমার দিনে কিম্বা তার পরের দিনে। সেইজন্য পাঞ্জাব সহ পশ্চিম ভারতে আজও তিনদিন ধরে রাখীবন্ধন উৎসব উদযাপিত হয়।
আর একটি কাহিনী আছে,১৫৩৫ সালে গুজরাটের সুলতান বাহাদুর শাহ্ রাজস্থানের চিতোর আক্রমণ করে। তখন চিতোরের বিধবা রানি শ্রীমতী কর্ণবতী দেবী চিতোরকে রক্ষা করার জন্য সেইসময়ের মোগল সম্রাট হুমায়ুনের কাছে নিজের ব্যবহৃত একটি ওড়না এবং রানীর অনুরোধ লিখে দুত মারফত পাঠান। হুমায়ুন খবর পেয়ে চিতোরে আসেনও,কিন্তু সামান্য দেরি হয়ে গিয়েছিল,তাই বাহাদুর শাহ চিতোর দখল করে নিয়েছিল,আর রানী নিজে এবং চিতোরের ১৩ হাজার পুরনারী আত্মসম্মান রক্ষার্থে জহরব্রতের আগুনে নিজেদের প্রাণ বিসর্জন দিয়েছিলেন। হুমায়ুন ব্যথিত হয়ে ক্রোধে বাহাদুর শাহকে পরাজিত করে চিতোর থেকে তাড়িয়ে দিয়ে রানির পুত্র বিক্রমজিৎ সিংহকে সিংহাসনে বসান।
পৌরাণিক,ঐতিহাসিক কাহিনী ছাড়াও আরও কাহিনি আছে।যেমন বঙ্গভঙ্গ-এর সময়ে ১৯০৫ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সারা ভারতে তথা বাংলাতে হিন্দু মুসলমান সম্প্রীতি রক্ষার্থে আবাহন করেছিলেন এই রাখীবন্ধনের উৎসব। পথে নেমেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। সাথে ছিলেন লক্ষ লক্ষ মানুষ। তিনি পায়ে হেঁটে নাখোদা মসজিদে গিয়ে সেখানকার ইমামের হাতে,উপস্থিত অন্যান্য মুসলমান নারী পুরুষের হাতে রাখী পড়িয়ে দিয়েছিলেন। রাখীবন্ধন উৎসবের এটিও এক প্রেক্ষাপট।
আসলে,রাখীবন্ধন উৎসবের পরিপ্রেক্ষিত অনেক বিশাল। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, যে যুগে যুগে জাতি-ধর্ম- বর্ণ- লিঙ্গ নির্বিশেষে সকলেরই কাছে মহা-পূণ্যতীর্থ ভুমি হোল আমাদের এই “ভারতভূমি”। “ভা”–শব্দের অর্থ হোল “জ্ঞানের আলো”, “রত” শব্দের অর্থ হোল “ব্যাপৃত”, আর “বর্ষ” শব্দের অর্থ “পূরাণোক্ত ভূ-ভাগ”। আত্মতত্ত্ব তথা ব্রহ্মতত্ত্ব অনুসন্ধানে ব্রতী ঋত্বিকগণের বিচরণভূমিই হোল আমাদের এই ভারতবর্ষ। ইতিহাস্নতাই প্রমাণ দেয়।
বোধহয় তাই ১৯৬৯-৭০ সালে, মানে আজ থেকে ৫৫ বছর আগে,আমাদের দেশে এই শ্রাবণী পূর্ণিমার তিথিকে “বিশ্ব সংস্কৃতি/ সংস্কৃত” দিবস হিসাবে ঘোষণা করেছিলেন কেন্দ্রীয় সরকার। আর তিনদিন ব্যাপী এই দিবস পালনের উৎসব পালিত হয়। এক্ষেত্রে উল্লেখ্য,ঋগ্বেদের সাম্যের সেই অমোঘ বাণীঃ–” সং গচ্ছধ্বং সং বদধ্বং/ সং বো মনাংসি জান্যতাম্”। অর্থাৎ, বিশ্বের সমস্ত মানুষ তথা প্রত্যেক ভারত বাসীই পরস্পরের প্রতি সৌভ্রাতৃত্বের সুনিবিড় বন্ধনে আবদ্ধ থাকবেন।এটিই হোল “সংস্কৃত দিবস তথা সংস্কৃতি দিবস”-এর পালনের মর্মবানী।
তাই,এই রাখীবন্ধনের অন্তর্নিহীত তাৎপর্য হোল,পুরোহিত দ্বারা রাজার,ব্রাহ্মণ দ্বারা যজমানের,দিদি বা বোন দ্বারা ভাই বা দাদার,মা দ্বারা সন্তানের,স্ত্রী দ্বারা স্বামীর, স্বামী দ্বারা স্ত্রীর,যে কোনও পুরুষ দ্বারা নারীর,যে কোনও নারী দ্বারা পুরুষের, এক জাতি বা সম্প্রদায় দ্বারা অপর জাতি বা সম্প্রদায়ের মানুষের দক্ষিণ হস্তে তার বা তাদের জন্য আন্তরিক শুভ কামনায় এবং সম্পর্কের সম্প্রীতি রক্ষার্থে রাখী বাঁধা হওয়াই হলো বৈদিক কর্মযজ্ঞ। অর্থাৎ সার কথা হোল,এই রাখী বন্ধণের মাধ্যমে মানুষে মানুষে পারস্পরিক অটুট সম্পর্ক,সম্বন্ধ-এর স্থাপনা,তাকে চিরস্থায়ী করার পবিত্র প্রয়াস।