পঙ্কজ চট্টোপাধ্যায়
আকাশের নীচে এই পৃথিবীর অনন্ত অঙ্গনে শস্য-শ্যামলিমা বাংলার লোকসঙ্গীতের পিলসুজে অনির্বাণ এক আলোর নাম আব্বাসউদ্দীন আহমদ—যে আলোয় ধুয়ে মুছে যায় বাংলার হিন্দু-মুসলমান হৃদয়ের যাবতীয় কালিমা।
এক অদ্ভুত সময়ে, আজ থেকে ১২৫ বছর আগে, অবিভক্ত বাংলার কুচবিহারের তুফানগঞ্জের বলরামপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেছিলেন সুরের পাখি আব্বাসউদ্দীন আহমদ। ১৯০১ সালের ২৭ অক্টোবর তাঁর জন্ম। বাবার নাম আলি জাফর আহমদ এবং মায়ের নাম ফতেমা বিবি।
সময়টা ছিল অস্থির। প্রথমে তুফানগঞ্জে এবং পরে কৃষ্ণনগরে পড়াশোনা শেষ করে আব্বাসউদ্দীন চলে আসেন কলকাতায়। ছোটবেলা থেকেই তিনি ভাওয়াইয়া গানের প্রতি আকৃষ্ট হন; আকৃষ্ট হন বাংলার লোকসঙ্গীতের প্রতি। আব্বাসের জন্মের অল্প কিছুদিন পরই বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী আন্দোলনের অগ্নিশিখা শহর থেকে গ্রাম-মফঃস্বলে ছড়িয়ে পড়ে—কলকাতা, বরিশাল, ময়মনসিংহ, কুচবিহার, দিনাজপুর, মেদিনীপুর, নদীয়া, ঢাকা, কুমিল্লা, যশোর, চট্টগ্রাম, রাজশাহী—সব জায়গায় গণজাগরণের ঢেউ। তখন আব্বাসউদ্দীনের বাল্যকাল।
তারুণ্যে এসে তিনি সেই আন্দোলনের আলোকবর্তিকাকে নিজের কাঁধে তুলে নিলেন। বলরামপুর থেকে প্রথমে কুচবিহার শহর, পরে তুফানগঞ্জ—চোখের সামনে দেখতে পেলেন চারণকবি মুকুন্দ দাসকে। দেখলেন স্বদেশী গান, গ্রেফতারি পরোয়ানা, কারাদণ্ড। দেখলেন সশস্ত্র বিপ্লবীদের আত্মবলিদান। চারদিকে স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা, প্রস্তুতি। দেখলেন ব্রিটিশ রাজের ষড়যন্ত্র—কীভাবে তারা হিন্দু-মুসলমানকে বিভক্ত করতে চাইছে। সেই যুবক সবই দেখছিলেন।
শেষমেশ বেরিয়ে পড়লেন ঘর ছেড়ে। নিজের “আমার শিল্পী জীবনের কথা” গ্রন্থে তিনি লিখেছেন—
“বৃহত্তর জীবনের স্বাদ এলো। সারা বাংলার গ্রামে-গ্রামে, শহরে-মফঃস্বলে ট্যুর করার অবাধ স্বাধীনতা। গেয়ে গেয়ে ফিরতে লাগলাম বাংলার শত সমস্যার সমাধানের বাণী।”
একজন শিল্পীর দেশের প্রতি যে প্রতিশ্রুতি ও দায়—আব্বাসউদ্দীন সেই পথেই হাঁটলেন। কলকাতায় এসে পরিচিত হলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, সলিল চৌধুরী, হেমাঙ্গ বিশ্বাস, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, সুচিত্রা মিত্র, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, দেবব্রত বিশ্বাস, মোহিনী চৌধুরী, শচীন দেব বর্মন, কৃষ্ণচন্দ্র দে, ঋত্বিক ঘটক, মৃণাল সেন, সত্যজিৎ রায় প্রমুখের সঙ্গে।
আব্বাসউদ্দীনের গান ছড়িয়ে পড়ল বাংলার গ্রাম, শহর, মফঃস্বল জুড়ে। তিনি গাইছেন—
“দুধের শিশু মায়ের কোলে কাঁদছে অন্ন অন্ন বোলে… সে যে কখন যেন পড়বে ঢলে রে ত্যাজি সবের যন্ত্রণা।”
– গানটি লিখেছিলেন কবি জসীমউদ্দিন।
তিনি আরও গাইলেন—
“ওরে রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ রে।”
– এটি লিখেছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম।
সঙ্গীতকে তিনি সত্যিকারের অস্ত্রে পরিণত করেছিলেন। গ্রামোফোন কোম্পানিতে বহু গান রেকর্ড করলেও তিনি মনে করতেন—খোলা মাঠে, মানুষের মাঝখানে দাঁড়িয়ে গানই তাঁর প্রকৃত পথ। বাংলার মাটির ঘ্রাণ, নকশীকাঁথার উষ্ণতা, জলের ওপর ঢেউ খেলে যাওয়া কলমী-হিংচে-শালুকপাতার সুবাস—এসবের মাঝেই তিনি খুঁজে পেয়েছিলেন ভাওয়াইয়া, ভাটিয়ালি, মুরশিদি, বিচ্ছেদি, ঝুমুর, ক্ষীরোলসহ লোকসঙ্গীতের প্রাণ।
প্রত্যেক লোকশিল্পী যেন তাঁদের কণ্ঠে খাঁটি মেঠো সুর ধরে রাখতে পারেন—এই পথ তৈরি করে গেছেন আব্বাসউদ্দীন। তাঁর গানে ফুটে উঠেছে গ্রামীণ জীবনের মর্ম, অন্তরের টান। এটি এক সাংস্কৃতিক বিপ্লব—বাংলার সত্তাকে বাঁচিয়ে রাখার বিপ্লব।
এই বিপ্লবই তিনি ভালোবেসেছেন আজীবন।
তাই হারিয়ে যেন না যান আব্বাসউদ্দীন আহমদ বাংলা সংস্কৃতির ভুবন থেকে। তাঁর জন্মের ১২৫তম বর্ষে এই বৈপ্লবিক মানুষের সঙ্গীতদর্শন ও জীবনালেখ্য যেন আমাদের অন্তরে গভীরভাবে গেঁথে থাকে—রইল সেই প্রত্যাশা।