পঙ্কজ চট্টোপাধ্যায়
আগেকার বিহার, এখনকার ঝাড়খণ্ডের দুমকার ছেলে প্রবোধ কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় (জন্ম ১৯.৫.১৯০৮ — চলে যাওয়া ৩.১২.১৯৫৬)। বাবা হরিহর বন্দ্যোপাধ্যায় ও মা নীরোদা দেবী। প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্র, গণিতে দারুণ পারদর্শী, কিন্তু হৃদয়ের নেশা—সাহিত্য। তাঁর লেখা উপন্যাস জননী পেরিয়ে গেল নব্বই বছরের পথ।
কালের স্রোতে সমাজ পাল্টায়, অভিরুচি বদলায়, জীবনধারা নতুন রূপ নেয়; মূল্যবোধেরও হয় রদবদল। তবু কি পুরনো সাহিত্য অচল হয়ে যায়? রবীন্দ্র-নজরুল আজও সমান আলোয় দীপ্যমান, বাকি অনেকে পাঠ্যসূচি বা গবেষণার পরিমণ্ডলে সীমাবদ্ধ। অথচ আমরা যে সাহিত্যিককে আজ স্মরণ করছি, তিনি লিখেছিলেন একেবারে ভিন্ন পথের সাহিত্য—তৎকালীন বাঁধা গৎকে ভেঙে।
রসিক বাঙালি পাঠকের কাছে নতুন স্বাদের সাহিত্য দিতে এসেছিলেন তিনি। সাহিত্যিক বুদ্ধদেব বসু তাঁর সম্পর্কে লিখেছিলেন—
“উপন্যাসের আসর সাজাতে হয়নি অতীতের কোনও নিরাপদ অধ্যায় বা বৈদেশিক কৌতূহলোদ্দীপক পরিবেশে। বর্তমান, প্রত্যক্ষ ও সমসাময়িকতার মধ্যেই তিনি আজীবন সাহিত্যশিল্পের উপাদান খুঁজেছেন।”
বন্ধুদের সঙ্গে বাজি রেখে লেখা তাঁর প্রথম গল্প অতসীমামী—যা বিচিত্রায় ছাপা হয়েছিল অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত ও উপেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের উৎসাহে—সেই গল্পকেই তিনি পরে বলেছিলেন “রোম্যান্সে ঠাসা অবাস্তব কাহিনি।”
আবার যে উপন্যাস পুতুলনাচের ইতিকথা সমালোচকদের কাছে ‘যুগোত্তীর্ণ’—তাকেই তিনি পরে বলেছেন “ন্যাতপেতে সেন্টিমেন্টাল কাহিনি।”
ক্রমে তাঁর সাহিত্য হয়ে উঠল ক্ষুধা, শ্রেণিদ্বন্দ্ব, দারিদ্র্য ও সংগ্রামের মুখপত্র। বাস্তবতা, যুক্তিবাদ, বস্তুবাদ—সব মিলিয়ে নির্মাণ করলেন এক অনন্য সাহিত্যভুবন। চৌল্লিশটি উপন্যাস ও তিনশো’রও বেশি গল্প লিখে তিনি নিজেই বলেছিলেন—
“লেখাই আমার রুজি।”
কিন্তু রুজি হয়নি। কখনো শাকভাত, কখনো শুকনো মুড়ি, কখনো করপোরেশনের জল—এই ছিল তাঁর জীবনের দিনযাপন। সস্তা জামাকাপড় জুটলেও জোটেনি অসুখের ওষুধ। তবু লেখার আগুন নিভে যায়নি।
ফ্রান্জ কাফকা বা জীবনানন্দের মতো তিনি নিজের পান্ডুলিপি লুকোননি—বরং দারিদ্র্যকে সঙ্গী করেই লিখে গেছেন জীবনভোর। তবু শেষ জীবনে তাঁর উপদেশ ছিল—
“পেটের সংস্থান না করে কেউ যেন সাহিত্য করতে না আসে।”
বাজারে বিক্রি হয়েছে তাঁর লেখা, প্রকাশকের লাভও হয়েছে। তাঁর কাহিনি অবলম্বনে সিনেমা হয়েছে—প্রযোজক-পরিচালকদের পকেট ভরেছে। কিন্তু যে কৃষকের জীবনের দারিদ্র্য তিনি ফুটিয়ে তুলেছিলেন সাহিত্যে, সেই দারিদ্র্যই তাঁকে তাড়িয়ে বেড়িয়েছে সারাজীবন।
সবচেয়ে মর্মান্তিক দৃশ্য—যেদিন তিনি মৃত্যুশয্যায়, সেদিন কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় তাঁর স্ত্রীকে বলেছিলেন—
“একটা ফোন করলেন না কেন, বৌদি?”
স্ত্রীর উত্তর—
“ফোন করতে যে এক পয়সা লাগে ভাই…” সুভাষ নির্বাক।
রবীন্দ্রনাথ ও শরৎচন্দ্রের উত্তরসূরী এই সাহিত্যিকের প্রকৃত সম্পদ ছিলেন পাঠকসমাজ। মৃত্যুর দিন সকাল থেকে সন্ধ্যা—মানুষের ঢল নেমেছিল তাঁর দেহদর্শনে। বলা হয়, রবীন্দ্রনাথের পর কোনও সাহিত্যিকের মৃত্যুতে এমন ঢল আর দেখা যায়নি।
ক্ষুধায় দগ্ধ যে মানুষটির দেহ প্রতিদিন পুড়ত, চিতার আগুনে শুয়ে হয়তো তিনি শেষবার ভেবেছিলেন—
“ফুলগুলো সরিয়ে নাও… আগুনের একটি রমনীয় ফুলকি আমাকে ফুলের সব ব্যথা ভুলিয়ে দিক।”
তিনি আর কেউ নন—
বাংলা সাহিত্যের তিন বন্দ্যোপাধ্যায়ের অন্যতম, পদ্মানদীর মাঝি-র স্রষ্টা—
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়।
অঘ্রাণের বিষণ্ণ দিনে—৩ ডিসেম্বর—জীবনের সঙ্গে লড়াই শেষে হারিয়ে গেলেন বাংলার “মানিক”, রেখে গেলেন এক তেজোদীপ্ত সাহিত্য-উত্তরাধিকার।