প্রথম পাতা প্রবন্ধ আজি হতে শতবর্ষ আগে মৃত্যুকে জয় করেছিল সভ্যতা

আজি হতে শতবর্ষ আগে মৃত্যুকে জয় করেছিল সভ্যতা

325 views
A+A-
Reset

পঙ্কজ চট্টোপাধ্যায়

হাসপাতালের একটি ওয়ার্ড।
সারি সারি রোগী, তারা খুবই অল্প বয়সী।
সকলেই গভীর ঘুমে। আসলে তারা কোমায় আচ্ছন্ন।
বলা যায় চির অন্ধকারের দেশে চলে যাওয়ার অপেক্ষায় থাকা যাত্রী তারা।

কি রোগ হয়েছে তাদের?
কোন চিকিৎসা নেই তাদের। প্রতিটি বিছানার পাশে পাথরের মতো বসে আছেন সেইসব অল্প বয়সী বাচ্চাগুলির অসহায় মা-বাবা। সকলেই বিষন্ন মনে,চুপচাপ বসে আছেন। মাঝেমধ্যে চোখের জল মুছছেন। তারা শুধু বসে আছেন। তাঁদের প্রাণপ্রিয় সন্তানের চির বিদায়ের অন্তিম সময়ের অপেক্ষায়।

পরিস্থিতিটা ভাবুন একবার। এই ২০২২ সালে বসে। একশ বছর আগের সেইদিনের কথাটি। সেদিনের সেই মা-বাবাদের কি নিদারুণ, অসহায়,করুণ মনের অবস্থা।
তাঁদের মনে বারবার প্রশ্ন—কোনও চিকিৎসা কি নেই?
কী অসুখ হোল ওদের?

জানা গেল অসুখের নাম। রক্তে সুগারের মাত্রা এত বেশী যে রক্ত হয়ে উঠেছে বিষাক্ত। পুরো Acid ডায়াবেটিস, আর এই অবস্থার নাম Daibetic- acute-Acidosis।

সময়টা ১৯২২ সালের জুন মাসের প্রথম সপ্তাহ।
টরোন্টো ইউনিভার্সিটির দু’জন চিকিৎসা বিজ্ঞানের গবেষক ডাক্তার এগিয়ে এসেছিলেন তাঁদের দীর্ঘদিনের দিনরাত এককরা বৈজ্ঞানিক গবেষণার লব্ধ ফলাফল নিয়ে। অবশ্যই তাঁরা একটি শপথ নিয়ে এসেছেন যে, যদি তাঁরা এই কাজে ব্যর্থ হন। তা হলে দেশ, সমাজ, বিচারে যে শান্তি দেবেন, তাই তাঁরা মাথা পেতে নেবেন। আর যদি সফল হন তাহলে এই আবিষ্কার সারা বিশ্বের সমস্ত মানুষের জন্য তাঁরা উৎসর্গ করে দেবেন।

সেই দুই ডাক্তার বিজ্ঞানী সোজা ঢুকে পড়লেন কোমায় আচ্ছন্ন সেই মৃত্যুপথযাত্রী শিশুগুলির ওয়ার্ড-এ। হাতে তাঁদের ইঞ্জেকশনের সিরিঞ্জ,প্রতিটি সিরিঞ্জেই ভরা আছে এক তরল।

ওষুধ, না কি বিষ?
সবাই উদগ্রীব, আশঙ্কিত।
হয় জীবন, না হয় মরণ।
উৎকণ্ঠায় সকলেই অপেক্ষায়। এক নম্বর বেড থেকে শুরু করলেন, প্রতিটি প্রায় অচৈতন্য বাচ্চার শরীরে ঢুকিয়ে দিলেন সেই ইঞ্জেকশন।
তারপর, পরপর এগিয়ে চললেন সেই দুই ডাক্তার বিজ্ঞানী একরাশ উত্তেজনাকর উৎকণ্ঠা নিয়ে।
অথচ এক বুক স্থির বিশ্বাস আর আশাও আছে।

মানব সভ্যতার ইতিহাসের এক মহা সন্ধিক্ষণ।
মৃতপ্রায় প্রতিটি কোমায় আচ্ছন্ন শিশুর শিরা খুঁজে খুঁজে সেই শিরার ভিতর ঢুকিয়ে দিচ্ছেন সেই তরল।

সে এক দম বন্ধ হয়ে যাওয়া পরিবেশ। সবাই যেন পাথর হয়ে গেছে। শুধু সেই দু’জন ডাক্তার ছাড়া।
শেষ শিশুটির শিরায় ইঞ্জেকশন দেওয়া শেষ হওয়ার আগেই প্রথম বেডের শিশুটি চোখ মেলে চাইলো ক্লান্তস্বরে “মা”” মা”বলে ডেকে উঠলো।
তারপর দ্বিতীয় বেডের বাচ্চাটিও চোখ মেলল।তার পর তৃতীয় বেডের শিশুটি, তার পর চতুর্থ শিশুটি,পঞ্চম শিশুটি—
একে একে সব শিশুগুলি চোখ মেলে চাইলো। আস্তে আস্তে তাদের বিছানায় বসিয়ে দেওয়া হোল। সেই মুহূর্তে সেই হাসপাতালের সেই ওয়ার্ড জুড়ে তখন কান্না, কান্না,আর কান্না
একে অন্যকে জড়িয়ে ধরে কান্না। আদরের শিশুদের গায়ে মাথায় মা-বাবাদের ভালোবাসার পরশখানি।

হাসপাতালের সিস্টার, অন্যান্য ডাক্তাররা,সাধারণ কর্মচারী,শিশুদের মা-বাবাদের,উপস্থিত সকলের চোখে শুধু অশ্রুর ধারারা বয়ে চলেছে অবিরাম ধারায়।
মানব সভ্যতার চিকিৎসা বিজ্ঞানের অন্যতম দিগন্তকারী আবিষ্কার।”ইনসুলিন হরমোন ” একটি ইঞ্জেকশন।
সে দিনের সেই মৃত্যুর উপত্যকায় এক মুহূর্তে জীবনের আলোয় আলোকিত করেছিলেন দুই বিশ্বখ্যাত চিকিৎসা বিজ্ঞানী, ডাঃ ফ্রেডেরিক গ্র‍্যান্ট ব্যান্টিং, এবং ডাঃ চারলস বেস্ট।
পরের বছর ১৯২৩ সালে দুজনেই নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন। সমস্ত টাকা দান করে দিয়েছিলেন মানুষের কল্যাণে গবেষণার কাজে। সে এক ইতিহাস।
১৯২২ এর জুনের প্রথম সপ্তাহের সেই ঐতিহাসিক দিন। শর্তবর্ষে তাঁদের কুর্ণিশ।

আরও খবর

মন্তব্য করুন

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.