শত বরষের আলোকপাতে একটি কবিতাঃ পঙ্কজ চট্টোপাধ্যায়

মধ্য কলকাতার দুটি বাড়ি। দুরত্ব বেশী নয়। একটি ৮ নং সদর ষ্ট্রীটের বাড়ি,যেখানে বসে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন ” নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ “…”আজি এ প্রভাতে রবির কর/কেমনে পশিল প্রাণের ‘পর”,..এই বাড়ির একটু দূরেই ৩/৪ সি,তালতলা লেনের আর একটি বাড়িতে একতলার দক্ষিন-পূর্বের একটি ছোট্ট ঘর,সেখানে থাকতেন দুজন মানুষ,একজন হলেন মুজফ্ফর আহমেদ্,আর অপরজন হলেন কাজী নজরুল ইসলাম। মুজফ্ফর আহমেদ্ তখন ” বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য”পত্রিকার সম্পাদক।আর কাজী নজরুল সদ্য প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষে ৩৯ নং বেঙ্গলী রেজিমেন্টের হাবিলদারের দায়িত্ব শেষ করে কলকাতায় এসে বসবাস করছেন,লেখালেখিও করছেন।কিছুটা নাম ডাকও হয়েছে।

১৯২১ সালের সেই সময়ের কলকাতা।চারিদিকে উত্তাল স্বাধীনতার আন্দোলন। সেই ১৯২১ সালের ডিসেম্বরের কনকনে শীতের এক রাতে মাঝরাতে ঘুম থেকে উঠে পেনসিল দিয়ে লিখতে শুরু করলেন কাজী নজরুল একটি কবিতা..একটানা লিখে গেলেন,লিখতে লিখতে ভোরের আলো ফুটে উঠলো। ঘুম থেকে উঠলেন সঙ্গী মুজফফর আহমেদ।নজরুল শোনালেন সেই কবিতাঃ ” বল বীর,/বল উন্নত মম শির,/শির নেহারি আমারি নত শির ঐ শিখর হিমাদ্রীর… “। মুজফফর আহমেদ বিস্মিত। পেনসিল কেন? কারনটা শোনা যাক মুজফফর আহমেদের স্মৃতি চারনেঃ “দোয়াতে বারবার কলম ডোবাতে গিয়ে তার মাথার সঙ্গে তার হাত তাল রাখতে পারবে না,এই ভেবেই সম্ভবত পেনসিলের শরণ নেওয়া।”

সেদিনই একটু পরে এলেন “মোসলেম ভারত” পত্রিকার মহঃ আফজালুল্ হক্।তাকেও শোনানো হল কবিতা।তিনি শুনেই পত্রিকায় ছাপার জন্য এক কপি চেয়ে নিলেন।
বেলা ১২ টা নাগাদ এলেন “বিজলী” পত্রিকার অবিনাশ ভট্টাচার্য ( বিপ্লবী অরবিন্দ ঘোষের ছোট ভাই বিপ্লবী বারীন্দ্রনাথের বন্ধু),তিনিও শুনলেন কবিতা এবং প্রশংসা করেই চাইলেন কবিতাটি।নজরুলও তাকেও এক কপি দিয়ে দিলেন।
১৯২২ সালের ৬ই জানুয়ারী বিজলী পত্রিকাতে প্রকাশ হোল কবিতা। প্রকাশ হতেই চারিদিকে সাড়া পড়ে গেল। প্রায় ২৭ হাজার কপি ছাপাতে হয়েছিল পত্রিকাটি।শুধু তাই নয় পরে এই কবিতাটিই “প্রবাসী” পত্রিকাতে সেই বছরেই,”মোসলেম ভারত” পত্রিকাতেও সেই বছরেই,আর জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়ি থেকে প্রকাশিত “সাধনা” পত্রিকাতেও সেই বছরেই ছাপানো হোল।

কাজী নজরুলের খুব ইচ্ছা ছিল,কবিতাটি কবিগুরুকে নিজে আবৃত্তি করে শোনাবেন।সেই মতো একদিন কবির সামনে হাজির নজরুল।পড়ে শোনালেন কবিতাটি।মুগ্ধ হয়ে রবীন্দ্রনাথ শুনলেন।শেষে যখন কাজী নজরুল বিশ্বকবির পায়ের ধুলো নিতে গেলেন,তখন গুরুদেব সন্তান সম কাজী নজরুলকে বুকে জড়িয়ে ধরে সেদিন আশীর্বাদ করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথের বয়স তখন ৬১ বছর,কাজী নজরুলের মাত্র ২২।
বাংলা সাহিত্যে আত্মপ্রকাশ ঘটলো এক বিদ্রোহী কবির তার “বিদ্রোহী” কবিতা দিয়ে। তার এই শত বরষের শুভ লগ্নে রইল অভিবাদন।

Related posts

‘মহিষাসুরমর্দিনী’- কিছু অজানা কথা

‘ইন্ডিয়া দ্যাট ইজ ভারত’, কিছু ঐতিহাসিক তথ্য

তিনিই ছিলেন একমাত্র “ঐক্যপুরুষ”