পঙ্কজ চট্টোপাধ্যায়
এইভাবেই বোধহয় সৃষ্টি হয় ইতিহাস। আর সেই সৃষ্টির ইতিহাস পরবর্তী সময়ে আমাদের বিস্মিত করে তোলে– আমরা ‘ অবাক হয়ে শুনি,কেবল শুনি,তুমি কেমন করে গান করো হে গুণী “।
একটি কবিতার শেষ স্তবক-এর পুনর্লিখন করলেন স্বয়ং মহাকবি রবীন্দ্রনাথ। তখন তিনি আর কয়েক দিন পরে তাঁর অশীতিতম(৮০ বছর) শুভ জন্মদিনের শুভক্ষণ অতিক্রম করবেন,পদার্পন করবেন একাশীতিতম জন্মদিনে–দিনটি ছিল ২৩ শে বৈশাখ, ১৩৪৮ বঙ্গাব্দ (৬ই মে,১৯৪১)।স্থান–শান্তিনিকেতন।
মাননীয় শান্তিদেব ঘোষ,রবীন্দ্রসঙ্গীত, বিশ্বভারতী গ্রন্থনবিভাগ,জ্যৈষ্ঠ /১৩৭৮ বঙ্গাব্দে(৩০ বছর পরে,১৯৭১ সালে) লিখছেনঃ–
” ১৩৪৮ বঙ্গাব্দের ২৫শে বৈশাখে গুরুদেবের জন্মোৎসব উপলক্ষ্যে যখন সমগ্র বাংলাদেশ মেতে উঠেছিল,আমি তখন শান্তিনিকেতনে ফিরে এসে গুরুদেবের সঙ্গে দেখা করি। তিনি আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন,–‘ পঁচিশে বৈশাখের দিন এখানে কী হবে?’ কথোপকথনে বুঝলাম,তিনি চান যে,এই জন্মদিন উপলক্ষ্যে নৃত্য-গীত ইত্যাদির আয়োজন হোক। তিনদিন আগের সন্ধ্যায়, আমি তাঁকে জিজ্ঞাসা করলাম,–উৎসবের সময়ে ‘আবার যদি ইচ্ছা কর’–গানটি কি গাইব? তিনি তাঁর জন্মদিনের গানের কথা শুনে বলেন বললেন,–
‘ তুই বেছে নে,আমি আমার জন্মদিনের গান বেছে দেব কেন?’
“এরপর কিছু সময় নীরব থেকে,তিনি ‘সার্থক জনম আমার..’ গানটি আবেগপূর্ণভাবে গেয়ে উঠলেন। বুঝলাম, দেশের প্রতি তাঁর ভালোবাসা কোনোদিন কমবে না,যদিও দেশ তখনো তাঁকে পুরোপুরি বুঝতে পারেনি।”
“পরের দিন সকালে ২৩শে বৈশাখ, আমি তাঁর কাছে গিয়ে বললাম,–‘ আপনি নিজের জন্মদিন উপলক্ষে কবিতা লিখেছেন,বক্তৃতা দিয়েছেন, অথচ একটা গান রচনা করেননি–এটা ঠিক মনে হয় না। এবারের পঁচিশে বৈশাখ-এ পুরো দেশ আপনার জন্মোৎসব করবে,এইদিন উপলক্ষ্যে একটা গান রচনা না হলে অনুষ্ঠান অসম্পূর্ণ হবে যে’।’ “
“তিনি শুনে বললেন,–
‘ তুই আবার এক অদ্ভুত ফরমাশ এনে হাজির করলি। আমি নিজে নিজের জন্মদিনের গান রচনা করব? লোকে আমাকে বলবে কি? দেশের লোক এত নির্বোধ নয়,তারা ঠিক ধরতে পারবে যে, আমি নিজেকে প্রচার করছি।’ “
“আমি বললাম-‘আপনি থাকতে থাকতে অন্যদের কাছে চাইবার কী প্রয়োজন? যখন জন্মদিনের কবিতা লিখেছিলেন, তখন কি কেউ আপনাকে দোষী করেছিল?’ তখন তিনি রাজী হয়ে,তাঁর জন্মদিনের কবিতাগুলি খুঁজে আনতে বললেন।”
“পঁচিশে বৈশাখ ” কবিতাটির “হে নূতন দেখা দিক আর-বার..” অংশটি একটু অদল-বদল করে, সুর যোজনা করলেন গুরুদেব। “
” পরেরদিন,২৪ শে বৈশাখ সকালে,গানটি আমার গলায় শুনে তিনি বললেন,-‘হ্যাঁ, এবার হয়েছে।’
“সেদিন একথা মনে হয়নি যে,এই গানটিই তাঁর জীবনের সর্বশেষ
গান সৃষ্টি হবে।”
গানটি —
” হে নূতন,
দেখা দিক আর-বার জন্মেরও প্রথম শুভক্ষণ।।
হে নূতন।
তোমারও প্রকাশ হোক কুহেলিকা করি উদঘাটন, সূর্যেরও মতন।
হে নূতন।
রিক্ততার বক্ষভেদি, আপনারে করো উন্মোচন।
ব্যক্ত হোক জীবনের জয়,
ব্যক্ত হোক তোমা মাঝে অসীমের চির বিস্ময়।
উদয়দিগন্তে শঙ্খ বাজে, মোর চিত্ত মাঝে
চির নূতনেরে দিল ডাক–
পঁচিশে বৈশাখ।
হে নূতন…”
কি অসাধারণ এই সৃষ্টি,কি অনিন্দ্য সুন্দর সেই সৃষ্টির কিছু সোনালী চিরস্মরণীয় মুহুর্তের ইতিহাস। ভাবলে অবাক হয়ে যেতে হয়,সেই মহামানবের মহাজীবনের অসীম অতল ব্যপ্তি,যা আমাদের সারা জীবনের প্রজন্মের পর প্রজন্মের কাছে এক ঐতিহাসিক ঐতিহ্যময় পরম্পরার সৌরভিত গৌরব –যে আমরা রবি ঠাকুরের জন্ম-মাটির সন্তান।আমাদের মাতৃভাষাই রবীন্দ্রনাথের মাতৃভাষা।রবীন্দ্রনাথ আমাদের আত্মার পরমাত্মীয়। আমাদের জীবনের পাথেয়।
আজ তাঁকে প্রণাম জানাই তাঁরই বাণীমঞ্জিরে:-
“তুমি রবে নীরবে,হৃদয়ে মম…
তুমি রবে নীরবে,
নিভৃত নিশীথ পূর্ণিমা,নিশীথিনী সম…
তুমি রবে নীরবে….”
মানব সভ্যতায় মননশীলতার চিরন্তন মানচিত্রের ব্যক্ত-অব্যক্ত কথা ও সুর..”রবি ঠাকুর “।
মায়ের মতন, অভিভাবকের মতন ধরে থাকেন হাত..,
তিনি তো রবীন্দ্রনাথ
তোমার আমার রবীন্দ্রনাথ।