“আমায় একটু জায়গা দাও,মায়ের মন্দিরে বসি…”, বাংলা গানের সারা শরীরের পুলকিত রোমাঞ্চ

পঙ্কজ চট্টোপাধ্যায়

হাজার হাজার বাংলা গান লিখেছেন তিনি তাঁর জীবদ্দশায়। আর সেই গানগুলো একের পর এক হয়ে গেল কালজয়ী অমরত্বের দাবিদার।

সেই গানগুলোর তালিকা দিতে গেলে জায়গা কুলোবে না। তাই কয়েকটি উল্লেখ করে যাই… যেমন,”জানি তোমার প্রেমের যোগ্য আমি তো নই…”। “সেই তো আবার কাছে এলে…”। “আবার হবে তো দেখা..”। “এই তো সেদিন তুমি আমারে বোঝালে..”। “ললিতা গো…”। “সুন্দরী গো দোহাই দোহাই..”। “ক’ফোঁটা চোখের জল ফেলেছ…”।” আজ আবার সেই পথেই দেখা হয়ে গেল..”।
” কথায় কথায় যে রাত হয়ে যায়..”। “তুমি অনেক যত্ন করে আমায় দুঃখ দিতে চেয়েছ…”। “তুমি একজনই শুধু বন্ধু আমার…”। “আমার ভালোবাসার রাজপ্রাসাদে…”।”ও কেন এতো সুন্দরী হলো…”। “ও চাঁদ সামলে রাখো জোছনাকে…”।”আমি ফুল না হয়ে কাঁটা হয়ে বেশ ছিলাম…”। “পৌষের কাছাকাছি রোদ মাখা সেইদিন…”। ” দীপ ছিল শিখা ছিল…”।”দুঃখ আমাকে দুঃখী করেনি…”। “সে আমার ছোট বোন…”। ” যখন কেউ আমাকে পাগল বলে…”।” না না যেওনা শেষ পাতা গো…”(এই গান সহ ছয় ঋতুর ১২ টি গান)…ইত্যাদি ইত্যাদি কয়েকশো গান শুধু মান্না দে-র কন্ঠে আজ ইতিহাস হয়ে আছে।এবং থাকবেও চিরকাল।

হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠে অসংখ্য গান। তার মধ্যে মিথ হয়ে আছে সেই বাবা আর মেয়ের গান…”আয় খুকু আয়…”।এছাড়া, “ও আকাশ প্রদীপ জ্বেলো না…”।”কতদিন পরে এলে…”।”কোনোদিন বলাকারা অতদুরে যেত কি…”।” নিঝুম সন্ধ্যায়…।” ইত্যাদি ইত্যাদি কয়েকশো গান বাঙলা ও বাঙালির কাছে অমরত্বের ইতিহাস রচনা করে দিয়েছেন পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়।

১৯৩৪ সালের ২রা মে হাওড়ার সালকিয়ার বাবুডাঙ্গাতে পুলক বন্দ্যোপাধ্যায় এর জন্ম। তাঁদের বাড়ির নাম সালকিয়া হাউস। পুলকের বাবা কান্তিভূষন বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন সেই নির্বাক যুগের বিখ্যাত অভিনেতা। পুলক হাওড়ার সালকিয়াতেই এংলো স্যাংস্কৃট স্কুলের ছাত্র ছিলেন।তারপর কলকাতার স্কটিশ চার্চ কলেজের স্নাতক হয়ে ছিলেন।

ছোট বেলা থেকেই কবিতা,গান লেখায় তার প্রতিভা ছিল অসাধারণ। তিনি মাত্র ১৭ বছর বয়সে সরোজ মুখোপাধ্যায় এর “অভিমান” ছবির জন্য গান লেখেন। পুলকবাবু প্রায় ৫ হাজারের বেশি গান লিখ্বছেন তাঁর ৫০ বছরের কর্মজীবনে।

তাঁর লেখা গান আধুনিক গান হিসাবে এবং সিনেমাতে বহু ভারত বিখ্যাত গুণী শিল্পীরা গেয়েছেন। যেমন,হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, মান্না দে,শ্যামল মিত্র,মহম্মদ রফি,কিশোর কুমার,লতা মঙ্গেশকর,আশা ভোঁসলে,গীতা দত্ত,সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, উৎপলা সেন,সতীনাথ মুখোপাধ্যায়, ভুপেন হাজারিকা,আরতি মুখোপাধ্যায়, প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়,হৈমন্তী শুক্লা,অনুপ ঘোষাল,অরুন্ধতী হোমচৌধুরী,প্রমুখ প্রমুখরা…।

বহু বাংলা সিনেমার গান পুলকবাবুর লেখা আজও বাঙালির মুখে মুখে ফেরে..। আগামী দিনেও চিরকাল অমর হয়ে থাকবে গানগুলো এবং তার গীতিকার কবি পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়।

তাঁর একের পর এক গান কালজয়ী। তবু তাঁর দুঃখ ছিল যে কেউ তাঁকে কবি বলেনা। তিনি কবি হতে চেয়েছিলেন, কিন্তু,শুধু গান লেখার কারণে তাঁকে কবি হিসাবে স্বীকৃতি দিলনা কবিতার সমাজপতিদের সিন্ডিকেট। তিনি তাঁর আত্মজীবনী… “কথায় কথায় রাত হয়ে যায়” বইতে লিখেছেন.. “এখনকার কবিরা আমাদের গীতিকার আখ্যা দিয়েছেন। যার ফলে আমরা শুধু গীতিকার হয়েই গেছি,কবি হতে পারিনি। বোধহয় এই কষ্ট তিনি সারাজীবন বয়ে বেড়িয়েছেন। আর বোধহয় সেইজন্যই তিনি শেষের সময়ে লিখেছিলেন.. “যখন এমন হয় জীবনটা মনে হয় ব্যর্থ আবরজনা/ ভাবি গঙ্গায় ঝাঁপ দি, রেলের লাইনে মাথা রাখি….”।

আর তারপর সত্যি সত্যি একদিন সব সময়ে সদাহাস্যজ্বল একজন কবি মানুষ কেন কে জানে ৭ ই সেপ্টেম্বর,১৯৯৯ তারিখে এক বিষন্ন-বিষাদী বেলা অবেলার কালবেলায় প্রকাশ্যে জনসমক্ষে চলমান লঞ্চ থেকে ঝাঁপিয়ে পড়লেন গঙ্গার বুকে অথৈ অতল জলের আহ্বানে। সে এক মর্মান্তিক ইতিহাস। তারপর তলিয়ে গেলেন কোথায় কে জানে।অবশেষে মরণের কাছে জীবনের শেষ নিবেদন শেষে উদ্ধার হয়েছিল বাংলা গানের প্রবাদপ্রতিম কবি-গীতিকার নিথর নিষ্প্রাণ পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়…।

সেদিন বাংলা সংস্কৃতি ও সঙ্গীত জগতে শুধুই কান্না আর ব্যাথা বেদনার ছিল অব্যক্ত বেদনার্ত আসা যাওয়া।
আর সেই আসা-যাওয়ার পথের ধারে গানের গীতাঞ্জলি নিয়ে ইতিহাস হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন পুলক বন্দ্যোপাধ্যায় চিরদিনের জন্য।আর থাকবেনও চিরকাল তিনি অমর অক্ষয় হয়ে।

Related posts

‘মহিষাসুরমর্দিনী’- কিছু অজানা কথা

‘ইন্ডিয়া দ্যাট ইজ ভারত’, কিছু ঐতিহাসিক তথ্য

তিনিই ছিলেন একমাত্র “ঐক্যপুরুষ”