পঙ্কজ চট্টোপাধ্যায়
বিশ্বকবির মননে, চিন্তা ভাবনায়, মৃত্যু বিচ্ছেদ নয়, তা হল মিলনের আবাহন। রবি ঠাকুরের কথায় -“মৃত্যু বড়ো মধুর,মৃত্যু জীবনকে মধুময় করে রেখেছে। জীবন বড় কঠিন,সে সবই চায়,সবই আঁকড়ে ধরে,তার বজ্রমুষ্ঠি কৃপণের মতো কিছুই ছাড়তে চায়না। মৃত্যুই তার কঠিনতাকে রসময় করেছে,তার আকর্ষণকে আলগা করেছে। মৃত্যুই তার নীরস চোখের জল এনে দেয়,তার পাষান স্থিতিকে বিচলিত করে।”
রবীন্দ্রনাথ ভালোবেসেছিলেন মৃত্যুর শান্ত,গভীর,নিবিড় পরিসমাপ্তিকে। তার আন্তরিক আলিঙ্গনকে।যেখানে কোনও ছলনা নেই,কপটিতা নেই।যা শাশ্বত সত্য।
মরণের মন্দ্র গম্ভীর মাধুর্যকে এক অনির্বচনীয় অভিব্যক্তিতে মহিমান্বিত করেছিল বিশ্বকবির মনন খানি। তিনি লিখেছিলেন -“সমুখে শান্তিপারাবার–/ভাসাও তরণী হে কর্ণধার…” গানখানি। শুধু তাই নয় গান তৈরী হওয়ার পরেই কবিবর রবীন্দ্রনাথ প্রিয় শৈলজারঞ্জন মজুমদারকে ডেকে এই গানটি শিখিয়ে দিতে দিতে কবিগুরু বলেছিলেন–” আজ হঠাৎ আমার যা মনে হল মৃত্যুর সেই রূপ এই গানে ধরা থাকল,তাই আমার জীবৎকালে এই গান তোমরা গেয়ো না।”
কথা অমান্য করেননি শৈলজারঞ্জন,সেই কথা মতো ২২ শে শ্রাবণ, বিশ্বকবির মহাপ্রয়ানের পরে, শৈলজারঞ্জন শান্তিনিকেতনের শোকসভায় তিন ছাত্রীকে সাথে নিয়ে গেয়েছিলেন সেই গানটি।
ইতিহাস বলে এই গানটি গাওয়ার পরে আর কোনও গান চলে না,রবি ঠাকুরের মহাপ্রয়ানের দিন।
রবীন্দ্রনাথ আজ আর নেই। তিনি তিরোহিত,সেদিন বাঙালীর মনের নকশীকাঁথা ছিল চোখের জলে সিক্ত,কবিগুরুর সেই মহাপ্রয়াণের তাৎক্ষণিক অভিঘাতে সেই গানটি পরিবেশনের সময়ে সকলেরই চোখে ছিল কান্না।
আজ এতোগুলো বছর পরেও তাই বাইশে শ্রাবণ আমাদের জাতির বুকের গভীরে,অনুভবে, এক অপার স্নিগ্ধ রিক্ততা বিরাজ করে। যে শূণ্যতায় হয়তো আমরা খুঁজে পাই আমাদের শান্তি,আমাদের নিজেদের আত্মদর্পণে আমরা দেখি আমাদের,মূল্যায়ন করি নিজেদের।অপেক্ষায় থাকি চিরকাঙ্ক্ষিত মুক্তির।
বাইশে শ্রাবণ তাই আমাদের কাছে এক অভিমানের দিন,এক বিনম্রতায় মহাকবির চরিণ ছুঁয়ে শ্রদ্ধায় আত্ম নিবেদনের দিন।