পঙ্কজ চট্টোপাধ্যায়
শারদীয়া দুর্গাপূজা মানেই এক আনন্দোৎসব। সব স্তরের মানুষের নিত্যদিনের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্নার আটপৌরে জীবনের মধ্যে ফুটে ওঠে এক অনন্যসাধারণ উচ্ছ্বাসের ফুলেল সমারোহ। “পুজো আসছে আসছে” অপেক্ষার শেষে কখন যে পুজো এসে যায়, আর বুঝে ওঠার আগেই যেন শেষ হয়ে যায় বিজয়াদশমীর আগমনে। আনন্দভরা শারদ প্রাতে বেজে ওঠে বিদায়বেলার ভৈরবী।
মনে মনে তখন একটাই ভাবনা— “আরও কয়েকটা দিন যদি এই পুজোর আনন্দের আয়ু বাড়ত!”
এই রকমই এক ইতিহাস পাওয়া যায় কালীপ্রসন্ন সিংহের ‘হুতোম প্যাঁচা’র নকশায়। সেই কলকাতাতেই (উত্তরে) কানাইধন বাবু ছিলেন এক নামজাদা আমমোক্তার। পুলিশের কাছ থেকে তিনি চার দিনের পুজোর বদলে আট দিনের অনুমতি নিয়েছিলেন। ফলে নিরঞ্জন হয়েছিল আট দিন পরে। হুতোম লিখেছেন— “চার দল ইংরেজি বাজনা, ঘোড়ায় তুর্কি সওয়ার, ফিরিঙ্গীদের নানা সাজ, নানা রকমের সঙ, প্রায় পঞ্চাশ জোড়া ঢাক…” — এইসব নিয়ে কলকাতার রাস্তায় বেরতেন পুজোর আয়োজকেরা।
চিৎপুরের বড় রাস্তায় তখন লোকে লোকারণ্য। রাস্তার দুই ধারে বাড়ির ছাদে, বারান্দায় বসে সেকালের রূপোপজীবিনীরা রূপোর হুকোয় তামাক টানতে টানতে সেই শোভাযাত্রা দেখতেন। হাটখোলা থেকে জোড়াসাঁকো, মেছোবাজার হয়ে যাত্রা শেষ হতো গঙ্গায় প্রতিমা বিসর্জনে। হুতোমের টিপ্পনী— “অনেক পরিশ্রমে যে বিশ-পঁচিশ হাজার টাকা সংগ্রহ করা হয়েছিল, আজ তারই শ্রাদ্ধ হলো!”
গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর বিখ্যাত ‘প্রতিমা বিসর্জন’ চিত্রে এই দৃশ্যই অঙ্কন করেছেন।
সেকালের পুজোর স্মৃতি জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখাতেও আছে— বাড়ির সকলে একসাথে শান্তিজল নেওয়া, পণ্ডিত বিষ্ণু গায়কের বিজয়ার গান ও কাহিনী। প্রসন্ন কুমার ঠাকুর লিখেছেন— “ঠাকুর ভাসান দেখে ফিরে মনটা কেমন একটু খারাপ হইত। প্রথম প্রথম কয়দিন খুবই কষ্ট বোধ হইত।”
কলকাতার জোড়াসাঁকো, শোভাবাজার, হাটখোলা, ভবানীপুর, পাথুরিয়াঘাটা, বিডন স্ট্রিট, আহিরীটোলা— বনেদি বাড়ির মেয়েদের ছিল অনেক কড়াকড়ি। প্রতিমা বিসর্জনে পুরুষদের মতো শোভাযাত্রায় যোগ দেওয়ার অনুমতি ছিল না। তাই বিজয়া দশমীর দিনে তারা বাড়ির ছাদে বা জানলায় দাঁড়িয়ে প্রতিমা বিসর্জনের দৃশ্য দেখতেন।
বিজয়া উপলক্ষে সন্ধ্যায় বসত “বিজয়া সম্মেলনীর” আসর। আসতেন বড় বড় ওস্তাদ, কবিয়াল, আখড়াই ও খেউড় দলের শিল্পীরা। বিখ্যাত ভোলা ময়রা, হরু ঠাকুর, এন্টনি ফিরিঙ্গী, গোরখনাথ— সকলেই তখন কলকাতার সাংস্কৃতিক জীবনের প্রাণ। ছিলেন নামজাদা বাঈনাচের শিল্পীরা— জদ্দন বাঈ, মীনা বাঈ, মুন্নী বাঈ প্রমুখ। আতশবাজির আলোয় ঝলমল করত আকাশ।
অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতিতে বিজয়া দশমী মানে ছিল পরস্পরের কোলাকুলি, পেন্নামের ডাক, মিষ্টিমুখ, আতর-পান ও গোলাপজলের ছড়াছড়ি। আর ছিল এক বিশেষ রীতি— নীলকণ্ঠ পাখি উড়িয়ে দেওয়ার।
আজও কিছু জায়গায় সেই ঐতিহ্য টিকে আছে। যেমন, কলকাতার হেদুয়ার ভোলানাথ ধামে প্রতিমা নামানোর পরে মহিলারা দেন “বেড়া অঞ্জলি”। দর্জিপাড়ার মিত্তিরবাড়িতে বরণের পরে দুর্গার হাতে ঝুলিয়ে দেওয়া হয় ঝাড়বাতির মতো “ঝাড়খিলি পান”। হাটখোলা দত্তবাড়ির লোকজন বিসর্জন শেষে ফেরার পথে সমবেত স্বরে দেশাত্মবোধক গান করেন।
এই বছর দক্ষিণ কলকাতার হাজরা মোড়ে যতীন্দ্র দাশ পার্ক মেট্রো স্টেশনের পাশে “গোস্বামী ধাম”-এর অম্বিকা পুজোয় দেখা গেল এক অনন্য দৃষ্টান্ত। বৈষ্ণব রীতিতে প্রতিষ্ঠিত এই প্রাচীন পুজোয় মহিষাসুর বধ নেই— আছে আসুরিক সত্তার উত্তরণের প্রতীকী রূপ। এই পরিবারের প্রয়াত পণ্ডিত প্রণয়কৃষ্ণ গোস্বামী ছিলেন রাষ্ট্রপতি পুরস্কারপ্রাপ্ত সারস্বত; তাঁর স্মৃতিতে এবছর পুরস্কৃত হয়েছেন শ্রীশ্রী জগন্নাথ গবেষক শেখ মকবুল ইসলাম।
এই ঘটনাই প্রমাণ করে, বাংলার ও ভারতের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য আজও আমাদের অন্তরে পারস্পরিক ভালোবাসা ও সম্প্রীতির বীজ বুনে যায়।
অশুভ শক্তির বিনাশে অন্তরের আলো জ্বালিয়ে তুলি শুভশক্তির দীপশিখা দিয়ে— এই প্রার্থনাই যেন থাকে সবার।
শেষে রবীন্দ্রনাথের আহ্বান স্মরণীয়—
“অন্ধকারের উৎস হ’তে উৎসারিত আলো,
সেই তো তোমার, সকল দ্বন্দ্ব-বিরোধ মাঝে জাগ্রত যে ভালো,
সেই তো তোমার ভালো।”
“তমসো মা জ্যোতির্গময়, অসতো মা সদ্গময়, মৃত্যোর্মা অমৃতং গময়।
ওঁ শান্তিঃ, ওঁ শান্তিঃ, ওঁ শান্তিঃ।”