প্রথম পাতা প্রবন্ধ অন্ধজনে দেহো আলো, মৃতজনে দেহো প্রাণ…

অন্ধজনে দেহো আলো, মৃতজনে দেহো প্রাণ…

246 views
A+A-
Reset

পঙ্কজ চট্টোপাধ্যায়

একটু চোখ মেলে তাকালেই আমরা দেখতে পাই সমাজের অসামঞ্জস্যতা, স্বার্থপরতা, অমানবিকতা। আবার তার বিপরীতও আছে। তাই দেখে আমরা বাঁচতে অনুপ্রেরণা পাই।

সমাজে সবচেয়ে উপেক্ষিত হয় প্রবীণ মানুষ, শারীরিক, মানসিক প্রতিবন্ধকতার মানুষ। আর উপেক্ষিত হন সহায় সম্বলহীন মানুষ।

কোলাজ-১

প্রতিবছর প্রবণ নাগরিকদের সামান্য সঞ্চয়ে সুদের হার কমানো। প্রাপ্য সুবিধার জন্য আধার সংযুক্তিকরণের জন্য অপেক্ষা, হয়রানি। সিনিয়র সিটিজেনদের বিভিন্ন ভরতুকি বন্ধ করে দেওয়া। “বেঁচে আছি” সেই প্রেক্ষিতে প্রমাণ দাখিল করা, সরকারি কোনও প্রজেক্টে নিজের শেষ জীবনের একটু সুরাহার জন্য ঘোষিত স্কিমের জন্য শাসক দলকে ‘প্রণামী’-করণ…অবহেলার, অন্যায়ের এমন করুণ নানা খবর সংবাদপত্রে প্রতিদিন প্রায় জানা যায়।

কোলাজ-২

সামাজিক ক্ষেত্রের পাশাপাশি পারিবারিক ক্ষেত্রেও শোনা যায় নানান অবিবেচক, অমানবিক কাহিনি। বয়স্ক মা-কে স্টেশনে বসিয়ে রেখে সন্তানের উধাও হয়ে যাওয়া। অবশ্য তার আগে বয়স্ক মা-কে দিয়ে, বা বাবা-কে দিয়ে সই করিয়ে সমস্ত স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে।

কোলাজ -৩

একদিন যে বাবা-মা তাদের সমস্ত কিছু দিয়ে সন্তানের কেরিয়ার তৈরি করে দেন, তারপর সেই সন্তান তার কেরিয়ারের জন্য চলে যায় মা-বাবাকে ছেড়ে। প্রথম প্রথম যোগাযোগ রাখে, পরে তা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। মা-বাবা বৃদ্ধ হন, পড়ে থাকেন ভিটেবাড়িতে একা একা। ফিরেও তাকায় না সেই সন্তান। যোগাযোগ থাকলেও নানান অজুহাতে সে আর মা-বাবার কাছে আসেনা। একটা ভালোবাসাহীন, দায়সারা গোছের সম্পর্ক তৈরি হয় সেখানে। আবার সন্তান প্রতিষ্ঠিত হয়ে মা-বাবাকে ফেলে নিজের বউ-বাচ্চাকে নিয়ে অন্য কোথাও তার নিজের সংসার গড়ে। অসুখের বিপদের খবর পেলে আসে, নচেৎ নয়।

আবার, নিজের কেরিয়ারের জন্যে অন্য রাজ্যে, বা বিদেশে না গিয়েও বাবা মা-কে কাছে রাখার জন্যে সন্তান অপেক্ষাকৃত কম রোজগারের চাকরি করে বাড়িতেই থাকে। এমন ঘটনাও জানা যায়, দেখাও যায়।

কোলাজ-৪

বিপরীত ঘটনাও দেখা যায়। ছোটবেলাতে মা-বাবা হারানো শারীরিকভাবে কমজোরি ভাইঝিকে চোখের মণির মতো ভালোবাসেন পরিবারের পিসি, কাকারা। এই আত্মত্যাগের জন্যে পিসিরা, কাকারা নিজেদের অনেক কিছু ব্যক্তিগত জীবনের স্বার্থ পরিত্যাগ করেছেন, বা স্বামী পরিত্যক্ত ভাগ্নী তার শিশু সন্তানকে নিয়ে এসে ওঠে মামারবাড়িতে। তাদের দেখভালের যাবতীয় দায়িত্ব নেন মামারা, মাসিরা। না কোনও অবহেলা নয়, অবজ্ঞা নয়। বরঞ্চ, সেখানে সবাই এক পরিবারেরই সদস্য একই ছত্রছায়ায়। এই আত্মত্যাগের জন্যে যথাযথ সম্মান বা স্বীকৃতিও হয়তো তারা পান না। তবু করে যান তাঁরা দায়িত্ব পালন নিরলসভাবে নিরন্তর। এ এক অনন্যসাধারণ মানবিকতার দৃষ্টান্ত।

পরিশেষে বলা যায়, যারা অসহায়, যারা কমজোরি, তাদের প্রতি আমাদের দায়বদ্ধতা অনেক অনেক বেশি। আর বাবা-মায়ের প্রতি তো বটেই। এই বাবা-মায়েরাই একদিন আমাদের জীবনের পথিকৃৎ। তাদের প্রতি পারিবারিক ভাবে, সামাজিকভাবে দায়িত্ব পালন করাটাই আমাদের কর্তব্য। পাশাপাশি দেশের, রাজ্যের সরকার, প্রশাসনেরও উচিৎ দেশের, সমাজের প্রবীণ নাগরিকদের প্রতি, দেশের কমজোরি মানুষের প্রতি রাষ্ট্রীয় দায়বদ্ধতা যথাযথভাবে পালন করা। কারণ, আমরা যে যেখানেই থাকি,যে পিদেই থাকি, আমরা প্রথমে মানুষ। সেই মানুষ হিসাবে আমাদের মনুষ্যত্ব এবং মানবিকতা অবশ্যই আমাদের থাকা উচিত। না হলে তো আমরা অমানুষ হিসাবে নিজেদের নিকৃষ্ট পরিচয় আমরা কি নিজেরাই দেব? নিজেদের নামিয়ে আনব নিকৃষ্টতার স্তরে?

অবশ্যই তা কখনোই নয়। তাই রবীন্দ্রনাথের সেই অমোঘ বাণী উচ্চারিত হোক আমাদের অন্তরে অন্তরে – “অন্ধজনে দেহো আলো, মৃতজনে দেহো প্রাণ।” স্বামী বিবেকানন্দের উচ্চারিত বাণী আমরা মহাবাণী হিসাবে গ্রহণ করি…”বহুরূপে সম্মুখে তোমার ছাড়ি কোথা খুঁজিছো ঈশ্বর, /জীবে প্রেম করে যেইজন সেইজন সেবিছে ঈশ্বর”। পরমপুরুষ শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের শিক্ষা- “শিব জ্ঞানে জীবের সেবা”। শ্রীমা সারদার উপদেশ- “ওরে সবার মাঝেই তিনি আছেন, তাই সেবা করো। একটু পাশে দাঁড়িয়ে তাকে সাহায্য করো”। কবি শক্তি চট্টোপাধ্যাযের কথায়- “তুমি মানুষের পাশে দাঁড়াও,মানুষ বড় কাঁদছে”।

আসুন মানুষের পাশে থাকি, মানুষের সাথে থাকি।

মন্তব্য করুন

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.