কলকাতা মহানগরে এক মহাতারকা এবং জন্ম শতবর্ষ

পঙ্কজ চট্টোপাধ্যায়

মাদ্রাজে জন্মেছিলেন ১৯২৫ সালের ৯ই জুলাই,বৃহস্পতিবার। বাবা-মায়ের আদরের দেওয়া নাম ছিল বসন্ত্ কুমার শিবশঙ্কর পাড়ুকোন। বাবা শিবশঙ্করজী সেই নাম কলকাতা মহানগরীতে এসে পাল্টে দিয়েছিলেন।কারন, একটা ছোট্ট এক্সিডেন্ট ঘটেছিল ছোট্ট ছেলেটির।নাম হোল গুরু দত্ত।

এই মহানগরীর ভবানীপুরে থাকতেন গুরু দত্ত। এখানে থাকতে থাকতেই কখন যে গুরুদত্ত পুরো বাঙালী হয়ে গিয়েছিলেন, তা কেউ জানেনা। শোনা যায়,বিশ্ববিখ্যাত নৃত্যসম্রাট উদয়শংকর-এর নাচের দলে,বা পুনেতে নৃত্যশিক্ষক, সহকারী পরিচালকের কাজ করার সময়েই নিজের নাম কে পরিচয়লিপিতে বাঙালীদের মতো লেখা হোত তাঁর নাম।তিনি খুশী হতেন।কারন অন্তরে, আত্মায় তিনি তো বঙ্গতনয়।

এই শহরে তাঁর বেড়ে ওঠা,সাংস্কৃতিকক চেতনার, মননশীলতার বৃদ্ধি,ঋদ্ধি। কিন্তু তিনি সেই দক্ষিণ ভারত থেকে কলকাতায় এসেছিলেন কেন? বাবা শিবশঙ্কর জী চাকরির সুত্রে সুদুর ব্যাঙ্গালোর থেকে কলকাতায় সপরিবারে চলে এসেছিলেন।প্রথমে ভবানীপুরে,পরে পদ্মপুকুর অঞ্চলে থাকতেন। কৈশোরে অবাক হয়ে দেখতেন কলিকাতার মহনগরের পথে পথে নানান দৃশ্য,শুনতেন বাউলের গান,গাজনের গান,সন্ধ্যারতির সময়ে গান,মহানগরের বিভিন্ন রাস্তায় বিভিন্নতার মাঝে এক ঐক্যের ছায়াছবি। দেখেছিলেন চিৎপুরের যাত্রা দলের যাত্রার অভিনয়।খুব আনন্দ পেতেন। এখানেই এক আত্মীয় নাম বি.বি. বেনেগালের আনা ফ্রি পাসে দিনে তিনটি করে সিনেমা দেখতেন ভাইবোনেরা,প্রধানত ধর্মতলা এলাকার সিনেমা হলে।
গুরুদত্তের সিনেমার প্রতি আকর্ষণ তৈরী হতে শুরু এই কলকাতাতেই। ক্যামেরায় কাজ করার শুরুও এখানেই। আর কিশোর গুরুদত্তের সেই অবিস্মরণীয় সাপ-নাচের সাক্ষীও কলকাতার ইডেন গার্ডেন্স, যা দেখে দৃশ্য-শ্রাব্য মাধ্যমে সেই ছেলেটির ভবিষ্যতের অসীম সম্ভাবনা বুঝতে পারেন সেই আত্মীয় বি.বি.বেনেগাল।মুগ্ধ হন একদিন তা দেখে স্বয়ং উদয়শংকর জী।তিনি ছেলেটিকে আড়মোড়ায় নিজের প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে ডেকে নেন। চলে যায় গুরুদত্ত।

প্রায় এক দশক ছিলেন তিনি এই কলকাতা মহানগরে। তারপর তিনি চলে যান সিনেমার কাজ করার স্বপ্ন নিয়ে বোম্বেতে। সঙ্গী হিসাবে পেলেন জ্ঞান মুখোপাধ্যায়, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়,শচীনদেব বর্মন,প্রমুখদের। গুরুদত্ত এতো সুন্দর বাংলা বলতেন,যে প্রথম সাক্ষাতে গীতা দত্ত, এবং গীতার বাবা,মা,সকলেই গুরুকে বাঙালীই ভেবেছিলেন। পরে বোম্বেতেই বাঙালি মতেই গুরু আর গীতার বিয়ে হয়। গুরু দত্তের মা,গুরু নিজে সুন্দর বাংলা লিখতেও পারতেন। আর আকর্ষণ ছিল বাংলা সাহিত্যের প্রতি।

গুরু দত্তের “পিয়াসা” ছবিতে এই শহর, গঙ্গার ঘাট, গঙ্গার পাড়ের বেঞ্চে বসা বেকার যুবক,হাওড়া ব্রিজ, ইত্যাদিকে আমরা দেখতে পাই। চরিত্রগুলিও বাঙালি। তাই বুঝি, সাহিত্যিক বিমল মিত্রের “সাহেব বিবি গোলাম উপন্যাসের হিন্দি চিত্ররূপ করেন ” সাহেব বিবি অউর গুলাম”, প্রযোজক স্বয়ং গুরু দত্ত। গুরু দত্তের ছবিতে, ভাবনায়, জীবনে তখন এক মহাকাব্যিক ধাত্রীভূমির নাম এই কলকাতা। সেই ছবিতে উঠে এলো,ক্ষয়িষ্ণু জমিদার প্রথা,তার অহংকার, তার আভিজাত্য, তার মেজাজ,তার ভালোলাগা- ভালো না লাগা,তার ষড়যন্ত্র, তার একাধিপত্যতার জেদ,ইত্যাদি,ইত্যাদি।উঠে এলো ঘোড়ায় টানা এক্কাগাড়ি, পায়রার বকবকম ঝটপটানি, স্টীমারের সাইরেনের সেই “ভোঁ”-এর আওয়াজ,শহরের বনেদীয়ানা,সোনার গয়না,বিলাসিতা, দেবীর মন্দির,নারীপুরুষ-এর গোপন প্রেম,মান-অভিমান, আশা-আশাহততা,ইত্যাদি ইত্যাদি। গুরুদত্তের ” কাগজ কে ফুল” ছায়াছবিতেও এই শহর উপস্থিত।

ভারতীয় চলচ্চিত্রের এক অনন্যসাধারণ ঐতিহাসিক নাম গুরু দত্ত। গুরু দত্তের প্রতিটি কাজ,তা সে অভিনয়ই হোক,পরিচালনাই হোক,প্রযোজনাই হোক, এমনকি তাঁর ব্যক্তিগত জীবনেও এই কলকাতা মহানগর গুরু দত্তের প্রথম ও একমাত্র আত্মীয়।

খুব অভিমানী ছিলেন গুরু দত্ত। প্রেমিক ছিলেন গুরু দত্ত। বিভিন্ন পুরস্কারে ভুষিত হয়েছেন তিনি সারাজীবন। চলচ্চিত্র শিল্পে গুরু দত্ত এক মহানক্ষত্র, যাঁর প্রথম ভালোবাসার নাম কলকাতা মহানগর।

গুরু দত্তের মহাপ্রয়ান ঘটে ১০ অক্টোবর, ১৯৬৪ সালে বোম্বেতেই। একান্তে হয়তো বিষন্নতায় কেঁদেছিলেন কেউ,কেউ, যার মনের একতারাতে বেজেছিল গুরু দত্তের প্রিয় কবি কাজী নজরুলের সেই অভিমানী গান–” আমি দূরে চলে যাব, তবু আমারে দেবনা ভুলিতে,/ আমি বাতাস হইয়া জড়াইব কেশ, বেণী যাবে যবে খুলিতে,—তবু আমারে দেব না ভুলিতে..”।

গুরু দত্তের জন্ম- শতবর্ষ আগামী ৯ জুলাই, ২০২৫, তাই এই বিনম্র শ্রদ্ধালিখন রইল গুরু দত্তের প্রতি।

Related posts

‘মহিষাসুরমর্দিনী’- কিছু অজানা কথা

‘ইন্ডিয়া দ্যাট ইজ ভারত’, কিছু ঐতিহাসিক তথ্য

তিনিই ছিলেন একমাত্র “ঐক্যপুরুষ”