প্রথম পাতা প্রবন্ধ সেই মহামারীতে কলকাতার বুকে সাইকেল নিয়ে রোগীদের চিকিৎসা করে বেড়াতেন এক চিকিৎসক

সেই মহামারীতে কলকাতার বুকে সাইকেল নিয়ে রোগীদের চিকিৎসা করে বেড়াতেন এক চিকিৎসক

499 views
A+A-
Reset

পঙ্কজ চট্টোপাধ্যায় :  সে এক ইতিহাস, এক উজ্জ্বল নিদর্শন এবং অধ্যায়।

১৮৮৩ সাল কলকাতার সেইযুগের মেডিকেল কলেজ থেকে কৃতিত্বের সাথে ডাক্তারী পাশ করে তিনি ইংল্যান্ড-এ আরও পড়াশোনা করার জন্য চলে যান। কয়েক বছর পর  চিকিৎসাবিদ্যার  শ্রেষ্ঠ অলংকারে ভুষিত হলেন MRCP হয়ে।

বন্ধু বান্ধব,আত্মীয়-স্বজন সকলেই বললেন তাঁকে ইংল্যান্ড-এ থেকে ডাক্তারি করার জন্য,এমন কি তাঁর শুভানুধ্যায়ী অধ্যাপকবৃন্দও তাঁকে বললেন বিলেতেই থেকে যাওয়ার কথা।

কিন্তু,না, যথারীতি তিনি ফিরে এলেন ভারতবর্ষে, ফিরে এলেন তাঁর জন্মভূমি, মাতৃভূমিতে এই বাংলায়। একজন বিলেত ফেরত ডাক্তার হয়ে তিনি দাঁড়ালেন এই বাংলার অসংখ্য,অসহায় গরীব মানুষদের পাশে। গরীব মানুষদের কাছ থেকে তিনি ফি-তো নিতেনই না, উলটে তাদের ওষুধ কেনার জন্য, পথ্য কেনার জন্য নিজের পকেট থেকে টাকা দিতেন।

আজকে এই ২০২০-২১ এ যেমন করোনার মহামারী-অতিমারী, ঠিক তেমনই গত শতাব্দির প্রথম দশকেই সারা পৃথিবীর মতো তখনকার এই বাংলাতেও এক ভয়ঙ্কর মহামারীর আকারে বিশাল সংখ্যার মানুষের রোগ-যন্ত্রনা আর অকাল মৃত্যু নিয়ে এসেছিল ‘প্লেগ’ রোগ।

এই বাংলার কলকাতাতেই প্রতিদিন শ’য়ে শ’য়ে মানুষ মারা যাচ্ছিল।পরিবারের রোগাক্রান্ত মানুষকে ফেলে অসুখের ভয়ে তার হাত থেকে  বাঁচতে পালিয়ে যাচ্ছে পরিজনরা। কলকাতার বিভিন্ন প্রান্তে উজাড় হয়ে গিয়েছিল এই মারণ ব্যাধি -প্লেগ।রাস্তায় পড়ে আছে মৃতদেহের সারি,কাতরাচ্ছে মরণ যন্ত্রনায় মানুষ। চারিদিকে এক দূর্বিষহ পরিস্থিতি,মানুষ কলকাতা ছেড়ে পালিয়ে যাচ্ছে দূরে, অন্যখানে কোথাও।

এই রকম এক ভয়াবহ অবস্থায় সব কিছুকে তুচ্ছ করে কলকাতার এক প্রান্ত থেকে আর এক প্রান্তে ঘুরে বেড়াচ্ছেন সেই এমআরসিপি  বিলেত ফেরত ডাক্তার মানুষটি।

চিকিৎসা করছেন রোগীদের,তাদের পরিজন,প্রতিবেশীদের সচেতন করতে উদ্যোগ নিচ্ছেন।সকাল থেকে শুরু হোত সেই মহান কর্মযজ্ঞ।একটা সামান্য সাইকেলে চড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন,অক্লান্তভাবে চিকিৎসা করে যাচ্ছেন বিলেত ফেরত একজন ডাক্তার পাড়ায় পাড়ায়, ঘুরে ঘুরে।

এই সময়ই একটি মানবতার দৃষ্টান্তমূলক ঘটনা ঘটেছিল। প্রতিদিনকার মতো সেই বিলেত ফেরত ডাক্তার মানুষটি রোগাক্রান্ত মানুষের সেবার কাজে সকালে বাড়ি থেকে বেরতে যাবেন, দেখেন বাড়ির সদর দরজার সিঁড়িতে বসে রয়েছেন অনিন্দ্যসুন্দর দেবী প্রতিমার মতো একজন  বিদেশী মহিলা, ডাক্তার মানুষটিকে দেখেই মহিলা নমস্কার জানালেন,প্রতি-নমস্কার জানালেন ডাক্তার ভদ্রলোক।

ভগিনী নিবেদিতা

তারপর তিনি জানলেন যে বাগবাজারের কাছেই একটি বস্তিতে বেশ কয়েকজন মানুষ প্লেগে আক্রান্ত হয়ে মরনাপন্ন অবস্থায় রয়েছে, তাদের একা ফেলে রেখে তাদের পরিবারের মানুষরা সবাই চলে গেছে প্রাণের দায়ে। এই বিদেশিনী তাদের শুশ্রূষা করেন, তাই তিনি এই ডাক্তার মানুষটিকে অনুরোধ করতে এসেছেন, সেই সব রোগীদের একটু দেখে দেবার জন্য।

ডাক্তার মানুষটি মোহিত হয়ে গেলেন সেই বিদেশিনীর এই মহত্ত্বের পরিচয় পেয়ে। তিনি সেই বিদেশিনীর সঙ্গে গেলেন সেই বস্তিতে।একে একে সমস্ত রোগীদের দেখলেন,ওষুধ দিলেন,আর সেই বিদেশিনীকে বললেন, যে তিনি যেন নিজের সুরক্ষার কথা মাথায় রেখে একটু সাবধানতা অবলম্বন করেন। বিদেশিনী প্রত্ত্যুতরে সেদিন বলেছিলেন, যে তাঁর সঙ্গে রয়েছে তাঁর পিতা সমান গুরুর আশীর্বাদ, তাঁর সেই পিতাসম গুরু মানুষের সেবা করার জন্যই তাঁকে দীক্ষিত করেছেন। ডাক্তার জানতে চাইলেন,সেই মহাপুরুষটি কে? তখন সেই মহিলা বললেন, ‘স্বামী বিবেকানন্দ।আর আমি তাঁর মন্ত্র দীক্ষিতা কন্যাসমা শিষ্যা।’

হ্যাঁ, ইনিই সেই বিশ্ব দুহিতা ভারত বন্দিতা মহীমাময়ী মিস এলিজাবেথ মারগারেট নোবেল ওরফে ভগিনী নিবেদিতা।আর সেই ডাক্তার-এর নাম ডাক্তার রাধাগোবিন্দ কর। যাঁকে আপামর জনগন চেনেন ‘আরজি কর’ নামে।

যাইহোক, সেদিন রোগী দেখে ফেরার পথে ডাক্তার আবার গিয়েছিলেন বাগবাজারের সেই বস্তিতে, গিয়ে দেখেন একটি ৮-১০ বছরের ছেলে এবং একটি ৬-৭ বছরের মেয়েকে কোলে নিয়ে বসে আছেন সেই বিদেশিনী। বাচ্ছা দুটি তখন মৃত্যু মুখে। প্রায় অচৈতন্য অবস্থায় তারা ‘মা’…‘মা’…‘মা-গো’….বলে আর্তস্বরে ডেকে যাচ্ছে। রোগ-ক্লীষ্ট হাতে ধরে রয়েছে সেই বিদেশিনীর পরনের গাউনের খুঁট। ধীরে ধীরে তাদের শেষ নিঃশ্বাস পড়লো। তারা চির ঘুমের দেশে চলে গেল অকালে, অসময়ে। ডাক্তার দেখতে পাচ্ছেন চোখের সামনে।

ডাক্তার আর.জি. কর-এর চোখে জল।অনুভবে সেই মহীয়সী-র পায়ে বিনম্রতার প্রনাম,আর সেই স্বামী বিবেকানন্দের প্রতি (যদিও বিবেকানন্দ ১১ বছরের ছোট ছিলেন,তবুও) আজন্ম অপরিশোধ্য ঋণ-এর কথা,যিনি এই দেশটাকে,এই জাতিটাকে মাথা উঁচু করে বাঁচতে শিখিয়েছিলেন।

সেই সময়ে এদেশের গরীব মানুষরা ভালো চিকিৎসা পেত না।কলকাতা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এদেশীয়দের ভালোভাবে চিকিৎসাই হোত না।তাই ডাক্তার কর মনস্থির করলেন,এদেশের মানুষের জন্যে একটি হাসপাতাল তৈরী করবেন।কিন্তু টাকা কোথায়?

ঠিক করলেন, ভিক্ষা করবেন,নিজের সব কিছু বিক্রী করে দেবেন।

যেমন ভাবা,তেমন কাজ। কলকাতার বড়লোক,ধনীদের কাছ থেকে ভিক্ষা করতে শুরু করলেন। কলকাতায় তখনকার দিনের বড়লোকদের বাড়িতে কোন আনন্দ অনুষ্ঠান হলে বা তাদের বিয়ের অনুষ্ঠানে ডাক্তার কর সেই বাড়ির গেটের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতেন,আর অভ্যাগত আমন্ত্রিতরা এলে ভিক্ষা চাইতেন ‘অনুরোধ, কিছু টাকা পয়সা যদি সাহায্য করেন, খুব উপকার হয়, সবার জন্য একটা হাসপাতাল তৈরি করতে পারি’।

সবাই দেখছেন, একজন বিলেত ফেরত MRCP ডাক্তার মানুষের জন্য হাসপাতাল করার জন্য ভিক্ষা চাইছেন।

পরিচিতরা বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞাসা করে,‘স্যার,ডাক্তারবাবু, আপনি!’

শ্রদ্ধায় তারা তাদের সাধ্যমতো সহযোগিতা করেন,আবার কেউ কেউ মুখ বেঁকিয়ে,পাশ কাটিয়ে চলেও যায়।

এইভাবেই ভিক্ষা করে,নিজের যাবতীয় সব বিক্রী করে তিনি তৈরি করলেন কলকাতার উত্তরে শ্যামবাজারের কাছে বেলগাছিয়ায় একটি হাসপাতাল, নাম দিলেন তাঁর শ্রদ্ধেয় মাষ্টার মশাই Doctor Albert Victor-এর নামে..”.Albert Victor Medical College and Hospital”

শুরু হোল এদেশের সাধারন মানুষের জন্য চিকিৎসা। পরে ১৯৪৮ সালে ডাক্তার বিধান চন্দ্র রায় এই হাসপাতালের নামকরন করেন..”Dr.R.G.Kar Medical College and Hospital”

 এই মহামহিম ক্ষণজন্মা পুরুষ ডাক্তার রাধাগোবিন্দ কর ১৮৫২ সালের ২৩ শে আগস্ট হাওড়ার ব্যাতোরে জন্মগ্রহণ করেন। সারাজীবনে মানুষের জন্য কাজ করে শেষে ১৯১৮ সালের ১৯ শে ডিসেম্বর চিরবিদায় নেন।

সারাজীবনে তিনি যাঁদের সাহচর্য, আশীর্বাদ,সহযোগিতা পেয়েছেন,তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন শ্রীমা সারদা,ভগিনী নিবেদিতা, শ্রী অরবিন্দ, বিজ্ঞানী জগদীশ চন্দ্র বসু,বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রমুখরা রয়েছেন।

আজ প্রায় শতবর্ষ পরে আবার আমরা আক্রান্ত এবং মুখোমুখি এক অতিমারী মহামারীর।এই মুহূর্তে এই ইতিহাস আমাদের অনুপ্রাণিত করে এই ভেবে যে,আমাদের দেশে,আমাদের বাংলায়,আমাদের বাঙালী জীবনে এমন মহা-মহিমাণ্বিত মানুষ ছিলেন। যাঁরা আমাদের পুর্বপুরুষ, তাঁদের সেই মহান ব্রতের আমরা উত্তরাধিকারী সেই মহান ব্রতের কর্মযজ্ঞের সেবাব্রতী হিসাবে নিজেরা যেন প্রমাণ করতে পারি।

মন্তব্য করুন

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.