পঙ্কজ চট্টোপাধ্যায়
দীর্ঘ অপেক্ষার শেষে আসে সারা বছরের আনন্দ নিয়ে শারদীয়া উৎসব দুর্গাপূজা। আর এই শারদীয়ার অলঙ্কার হোল মানুষের জীবনের কৈশোরের চিরন্তন প্রতীক অপু-দুর্গার সেই হারিয়ে যাওয়া দূর দূর দিগন্ত বিস্তৃত সাদা পালকের মতো সাদা কাশ ফুলের বনে। আচ্ছা এই কাশ ফুল তো ফুলের জগতে বড্ড অনাদরে জন্মায়,লালিত পালিত হয়।তবু তার এই অবহেলিত জীবন প্রাধান্য পায় কি করে শরতে? কেউ জানেনা,শুধু সেই-ই জানে,কি অমোঘ আন্তরিকতায়,কি পরম আত্মীয়তায় সে ঠাঁই পায় শরতের ভাদ্রে বিশ্বকর্মা-র আরাধনায়।
আবার শরতের আশ্বিনে নদীমাতৃক ভূমাভূমিতে কপোতাক্ষ,খোয়াই,
গঙ্গা পদ্মা ধানসিঁড়ি, শিপ্রা নদীর তীরে বাংলার সুজলাং,সুফলাং শ্যামলিমা প্রান্তরে আলতায় আলতো রাঙানো পা ফেলেন মেনকা-গিরি নন্দিনী যিনি আদরের আত্মজা উমারানী, শান্তিময়ী- “অয়ি গিরি নন্দিনী”-র পদপ্রান্তে তার পরম প্রার্থীত আশ্রয় মেলে। কাশফুলের আর এক নাম ” কুশ”,যা সরল সহজ শুভ্রতার সাত্বিকতার প্রতীক। স্বর্গ-এর অধিবাসীদের আসন হোল এই কাশ,যা কুশাসন বা কাশাসন নামেই পরিচিত। কাশ ফুলের সহজাত বৈজ্ঞানিক নাম তাই বুঝি সাচ্চারাম স্পন্টেনিয়াম(saccharum spontaneum)।কাশ ফুলের সারা শরীরে যেন লেগে থাকে ঝরে যাওয়ার এক বিষন্নতা।
বিষন্নতার কথা বললেই মনের মধ্যে জেগে ওঠে তার কথা। সে পারিজাত।শরতের অনেকখানি জায়গা জুড়েই আছে আদ্যিকালের পারিজাত বৃক্ষ। আর এই পারিজাতেরই নাম শিউলি ফুল। শিউলির আর একটি নাম হরশৃঙ্গার।স্বর্গ-এর ঐশ্বরিক ফুল হলো এই পারিজাত,মানে এই শিউলি।
কাশ আর শিউলির কথা মানেই শরত কাল,আর শারদীয়া দুর্গাপূজা। শিউলি-ই একমাত্র ফুল,যা কুড়োনো হয়,তারপর তার স্থান হয় পুজার থালায়। আমরা তো জানিই না বোধহয়, যে এই শিউলি ফুল হলো পশ্চিমবঙ্গের জাতীয় ফুল।শিউলিই একমাত্র খসে পড়া ফুল, যা পুজায় লাগে। তার এই ঝরে পড়ার মধ্যে থাকে বোধহয় এক ধরনের বিষন্নতা। তাই বুঝি,শিউলির বৈজ্ঞানিক নাম “নিকট্যান্থেস আরবার-ট্রিস্টিস”। আর এই “আরবার ট্রিস্টিস” ল্যাটিন শব্দ,যার মানে হোল বিষন্নতা। শিউলি গোধুলির ম্লান আলোকে ফোটে,আর সারারাত গন্ধ বিলিয়ে দিয়ে সকালে সূর্য আলো তার গায়ে মেখে সে ঝরে পড়ে মাটির বুকে–“ফুল বলে ধন্য আমি,ধন্য আমি মাটির ‘পরে…”। তার অপর নাম হোল “Tree of sorrow”। তাই দুঃখী, তার বিষন্ন কাতর রূপটি নিয়ে সে শান্তির আশ্রয় খুঁজে পায় জগজ্জননী দেবী দুর্গার রক্ত-অলক্তক দুটি শ্রীচরণে।
এই কাশফুল আর শিউলির গন্ধ মেশা স্মৃতি মাখা শৈশব,কৈশোর লুকিয়ে আছে,লুকিয়ে থাকে আমাদের জীবনে। গ্রামে গ্রামান্তরে,শহর শহরতলীর আশেপাশে বেজে ওঠে দুর্গাপূজার ঢাক,শুরু হয় বোধন,শুরু হয় নবপত্রিকা স্নান,শুরু হয় সন্ধিপুজা,আসে মহানবমীর সেই বিষাদ নিশীথ রাত্রি,আর তার অবধারিত বিদায়ের পরেই আসে বেদনা বিদুর মহাদশমীর বিদায়। মনে পড়ে কতো অপেক্ষার কথা,মনে পড়ে কতো ভালোলাগা,রোমাঞ্চিত কথা ও কাহিনির কথকতা।
আসলে শিউলি,কাশফুল এক ফেলে আসা শৈশবের,কৈশোরের,
হারিয়ে যাওয়া জীবনের গল্প। দ্রুত ফুরিয়ে যাওয়াতেই তার চরিতার্থতা, তাই মানুষ তার নিজের জীবনের সাথে,অভিজ্ঞতার সাথে,তাকে মিলিয়ে নিতে পারে,মিলে যায়।
তাকে দীর্ঘ সময়ের জন্যে আটকে রাখা,আগলে রাখা যায়না।” যা হারিয়ে যায়,তা আগলে বসে রইব কতো আর..”।
আমাদের সম্পর্কগুলি অতি স্পর্শকাতর,পদ্মপাতায় জলের মতো অতি ক্ষণস্থায়ী।শিউলির মতো, কাশের মতো সারা দিনমান শেষে গোধুলিতে, সন্ধ্যায় দিনের আলতো উত্তাপ যখন বিনম্র,তখন সে ফোটে,সুগন্ধ বিলায়।সমস্ত রাত্রি জুড়ে তার একান্ত একাকী অভিসার।তারপর সূর্য-এর আলোর আগমনে যখন ব্যস্ততায় দিন গত পাপক্ষয় শুরু হয়, তখন ধীরে ধীরে সরে যায় শিউলি ফুল। কতকটা যেন শিউলির এই জীবনচক্রে আমাদের অতি কাছের প্রিয়জনেরা, যাঁরা এইতো ছিলেন,আবার হঠাৎ করে কখন তাঁরা “আর নেই” হয়ে গেছেন,– আমাদের জীবনের নকশীকাঁথা জুড়ে তাঁদের আদর,স্নেহ,
ভালোবাসার গন্ধ ছড়ানো থাকে,রয়ে যায়,থেকেই যায় সেই সুবাস।
মায়েরা শিউলি কুড়িয়ে ফুলের সাজি ভরান,কখন সেই সাজি পড়ে থাকে জীর্ণ শীর্ণ অবহেলার অনাদরে একা একা,তবু মায়ের সেই শিউলি সঙ্গ স্মৃতি ছবি থেকে যায়।
ঠাকুমা, দিদিমা, শিউলি ফুল দিয়ে ঠাকুরের আসন সাজাচ্ছেন,সেই ঠাকুমা দিদিমা চলে যান,পড়ে থাকে দেবতার আসনখানি, স্মৃতিস্তবের স্মৃতিচারণে।
সেই যে আমার মা,আমার দিদা,ঠাকুমা, আমার অতি প্রিয়জন এইতো ছিলেন, কোথায় চলে গেলেন তারা পথের মতো হারিয়ে,সময়ের মতো ফুরিয়ে গেলেন কেনো? দিনের আলো ছায়ার মতো মিলিয়ে গেলেন কোথায়? বাবা,ঠাকুরদা,দাদা,
দিদি,ভালোবাসার জন,প্রিয়জন কোথায়,কোথায় হারিয়ে গেল? ধু ধু এই ধুসর পৃথিবীতে একা রেখে আমায়?
তাঁরাও কি শিউলি ফুল কুড়িয়ে আনতে চলে গেছেন সে কোন্ অজানা শিউলি বনে? কাশের বনে দিদি দুর্গার হারিয়ে যাওয়া যেমন, অপুর দুচোখ জুড়ে!!
এই যে আজ পরম নিশ্চিন্তে প্রিয়জনের হাত ধরে থাকা,হঠাৎ কখন পলক ফেলতেই মুছে যাওয়ার নামই বোধহয় জীবন মরণের সীমানা। তাই খুশীর মুখরতায় আমরা চিরবিষন্ন বিষন্ন অংশীদার শিউলির মৌনতায়। এটাই চির অনিবার্য।
“Time marches on but memory stays” (Lord Tennyson)
আনন্দের উৎসবে আমাদের সমানুভূতি, সহানুভূতি জেগে থাকুক বিষন্নতায় আছেন যারা,তাদের জন্যে। কারণ আমাদের জীবনের আর এক নাম ভালোবাসা,মরমী দরদ। আর শারদীয়া দুর্গাপূজা মানেই কাশফুল,শিউলি ফুল।