প্রথম পাতা প্রবন্ধ চির অনন্য কিশোর কুমার

চির অনন্য কিশোর কুমার

1K views
A+A-
Reset

পঙ্কজ চট্টোপাধ্যায়

১৯২৯ সালের ৪ আগস্ট (বাংলার ১৯ শে শ্রাবণ,১৩৩৬ বঙ্গাব্দ) মধ্যপ্রদেশের খান্ডোয়া জেলায় কিশোর কুমারের জন্ম।

মায়ের নাম গৌরী দেবী আর বাবার নাম কুঞ্জলাল গঙ্গোপাধ্যায়। মা নাম রেখেছিলেন “আভাস’’। তিনি এক দিদি এবং দুই দাদার (সতী দেবী/দিদি,অশোক কুমার/দাদা,অনুপ কুমার/দাদা) সবচেয়ে ছোটভাই ছিলেন।

প্রথমে পড়াশোনা খান্ডোয়ার নিউ হাইস্কুলে। তারপর সেখান থেকে কলেজের পড়াশোনার জন্য চলে যান ইন্দোরে, সেখানে তিনি ভর্তি হন ক্রিশ্চিয়ান কলেজে।

পড়াশোনার পাশাপাশি চলতো গান,বাজনা,অভিনয় করা—এগুলোও চলতো। একটা অসামান্য স্বাভাবিক প্রতিভা ছিল তাঁর। যে কোন সুর এক’দু বার শুনলেই তিনি তা হুবহু পরিবেশন করতে পারতেন।বাড়ির সবাই,পাড়ার সকলে তা দেখে বা শুনে অবাক হয়ে যেতেন।বাহবা দিতেন।

সব কিছু করলেও কিশোরের খুব ভালো লাগতো গান গাইতে। তাঁর গানের প্রথম রেকর্ড হয়েছিল, যখন তাঁর বয়স ১৬/১৭।ছবির নাম ছিল “এইট ডেজ” (১৯৪৬)। গানটি ছিল “মনকা সিপাহীয়া ঘর যায়ে হো”(তিনজন শিল্পী গেয়েছিলেন,তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন কিশোর কুমার।

কিশোর কুমারের বড়দা অশোক কুমার সেই সময়ে বোম্বেতে (এখনকার মুম্বাই) চলচ্চিত্র জগতে বেশ নামকরা নায়ক হিসাবে পরিচিত।অশোক কুমারেরই অভিনয়ের একটি গান ” ম্যাঁয় বন কে পনছি বন বন কে… ” ছোটবেলায় বাড়িতে খুব গাইতেন। সবাই হাততালিও দিত প্রশংসাতে। গানটি গাওয়ার সময়ে এবং পরবর্তী সময়েও তিনি গান করতেন তখনকার বিখ্যাত নায়ক গায়ক কুন্দল লাল সায়গল-কে অনুকরন করে। পরে শচীন দেব বর্মনের পরামর্শ অনুযায়ী তিনি গান গাওয়ার স্টাইল পাল্টান। সেই সময়ে হিন্দী গানের জগতে বিরাজ করছেন  হেমন্ত কুমার,মহম্মদ রফী সাহেব এবং মুকেশ সাহেব। কিশোর কুমার নিজের গানের স্টাইল সম্পূর্ণভাবে আলাদা রকমের করে গলাকে ভেঙে গান করার স্টাইল এদেশের গানের জগতে নিয়ে এলেন।

১৯৪৬ সালে “শিকারী” ছবিতে কিশোর কুমার প্রথম সম্মানীয় শিল্পী হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেন। প্রথম একক প্লেব্যাক করেন ১৯৪৭ সালে “জিদ্দি” সিনামাতে। শচীন দেব বর্মনের মতো আর একজন সুরকার খেমচাঁদ প্রকাশজিও কিশোর কুমারের প্রতিভা বুঝেছিলেন প্রথম দিকে।তাই, তিনিই “জিদ্দি” ছবিতে কিশোরকে দিয়ে গান করান।

কিশোরের গানের জগতে প্রবেশের পাশাপাশি অভিনয়ের জগতেও অনেক প্রতিকুল অবস্থার মধ্যে থেকেই নিজের স্বকীয়তাকে সকলের নজরে আনতে হয়েছিল। কারণ তখন চিত্র জগতে নায়কের ভূমিকায় রাজ করছেন রাজ কাপুর, দেব আনন্দ,দিলীপ কুমার প্রমুখরা। সেখানে কিশোরের স্বাভাবিক অভিনয়,হাসিতে যেমন,দুঃখেও তেমন অত্যন্ত সাবলীল অভিনয়ই ছিল কিশোর কুমারের বৈশিষ্ট্য এবং  দর্শকবৃন্দ অতি আনন্দের সাথে তা গ্রহণ করেছিল এক অন্য রকমের আস্বাদ হিসাবে। ফল স্বরূপ গত শতকের পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি থেকে তিনি ছিলেন এক প্রবল ব্যস্ত এবং সফল নায়ক ও গায়ক। পরে তিনি নিজে সুরকার হিসাবে,চলচ্চিত্র প্রযোজক হিসাবেও নিজের প্রতিভার সম্যক পরিচয় দিয়েছেন।

কিশোর কুমার প্রথম নায়ক হিসাবে কাজ করেন ১৯৪৮ সালে “সতী বিজয়” ছবিতে।আর প্রথম বাংলা ছবিতে নায়কের (দ্বৈত ভূমিকায়) চরিত্রে অভিনয় করেন ১৯৫৮ সালে “লুকোচুরি” ছবিতে। তারপরে ক্রমে ক্রমে  ” মধ্যরাতের তারা”(১৯৬১) “একটুকু ছোঁয়া লাগে”, (১৯৬৫),  ” দুষ্টু প্রজাপতি”(১৯৬৭) নায়ক হিসাবে কাজ। তাছাড়াও গায়ক হিসাবে অসংখ্য বাংলা সিনেমা রয়েছে।বিশেষ করে উল্লেখযোগ্য বিশ্বখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের “চারুলতা” সিনেমাতে কিশোরের সেই খোলা গলায়। “আমি চিনি গো চিনি তোমারে ওগো বিদেশিনী (রবীন্দ্রসঙ্গীত)।

শোনা যায় সত্যজিতের “গুপী গায়েন বাঘা বায়েন “. সিনেমায় ” গুপী গায়েন”-এর গানগুলি সত্যজিত চেয়েছিলেন কিশোর কুমার কে দিয়ে গাওয়ানো। কিন্তু হয়নি।তার কারণ হিসাবে জনশ্রুতিতে আছে যে, সেই সময়ে কিশোর কুমার বোম্বেতে খুব।ব্যস্ত ছিলেন,তাই সময় দিতে পারেন নি। কিন্তু মনে হয় তা নয়। কারণ সত্যজিতের পরিবারের সঙ্গে কিশোর কুমারের পরিবারের গভীর-নিবিড় সম্পর্ক  ছিল-আছেও। রাজনৈতিক মহলে ঘুরে বেড়ায় একটি কথা যে তিনি এক অত্যন্ত প্রভাবশালী নেতার কথামতো কাজ না করতে পারার জন্য তাঁর গান গাও,অনুষ্ঠান করা ইত্যাদি বিষয়ের ওপর তখন restriction জারি করা হয়েছিল। যদিও এওসব তথ্যের কোন প্রামাণ্যতা নেই। কিন্তু সেই সময়ের সেই সব গান আজও চির নতুন যেমন “এই সুন্দর স্বর্ণালি সন্ধ্যায় একি বন্ধনে জড়ালে গো বন্ধু..” আর বাংলা গানে সেই প্রথম র‍্যাপ… “শিং নেই তবু  নাম তার সিংহ..”, “দিনের শেষে ঘুমের দেশে. বা ” ওগো নিরূপমা…”.(অনিন্দিতা)  কিশোরের গাওয়া, বাংলা সঙ্গীতে সে এক অগ্রগতির ইতিহাস,এক মাইলস্টোন।

কিশোর কুমারের প্রথম সিনেমাতে মিউজিক ডাইরেকশন ছিল “ঝুমরু” ফিল্মে।প্রথম চলচ্চিত্র পরিচালনা করেন “দূর গগন কি ছাঁও মে..” সিনেমাটি। প্রথম ফিল্ম প্রোডাকশন ছিল “লুকোচুরি” বাংলা ছবি দিয়ে। প্রথম ডুয়েট গান করেন “জিদ্দি” (১৯৪৭) ছবিতে লতা মঙ্গেশকরের সঙ্গে।গানের কলি ছিল ” য়ে কৌন আপ”। আশা ভোঁশলের সাথে প্রথম ডুয়েট গান করেন “মুকদ্দর” (১৯৫৩) ছবিতে।গানের কলি ছিল ” আতি হ্যায় ইয়াদ হামকো জানুয়ারি ফেব্রুয়ারি “।

মান্না দে-র সাথে প্রথম ডুয়েট করেন “পড়োসন” (১৯৬৩) ছবিতে রাহুল দেব বর্মন-এর সঙ্গীত পরিচালনায়।

সিরিয়াস গান যেমন গেয়েছেন,তেমনি মজার মজার গানও করেছেন বহু।তিনি গান করেছেন ভারতের সব ভাষাতেই। তিনিই প্রথম এদেশে।যিনি একই গলায় পুরুষ কণ্ঠ এবং নারী কণ্ঠ ব্যবহার করে গান করেছেন।তার উদাহরণ, ” হাফ টিকিট” ফিল্মে গান..”আকে সিকি লোকি”, আবার ” রঙ্গিলা” ছবিতে..” সাঁইয়া ছোড়ো বালম”।

গান,অভিনয়,পরিচালনার পাশাপাশি তিনি ধরলেন কলম,লিখলেন কবিতা…”সুপারিন কে সাথ মশালা মিলে ভান্ড ভান্ড,/জাম-এ-কস্তে কি বাত্তি ভর থোড়িসি লালি হ্যায় /

বৈঠে হ্যায় সভা,মান হী বাত করে ভাঙ ভাঙ,/ থুকন যা তো বারবার জানে ক্যা বাধাই,/ হ্যায় কহনো কবি কিশোর দাস চতুরন কী চতুরাই,/সাথ পান মে তাম্বাকু কিসী মুর্খ নে চালাই?”

মানুষ হিসাবে ছিলেন অত্যন্ত মুডি। যেমন,তিনি দুটি ফিল্ম পনেরোবার করে দেখেছেন,নিজেই বলেছেন সে কথ।একটি হোল ” ওয়াটারলু ব্রীজ” আর দ্বিতীয়টি হোল  “পথের পাঁচালি”।

সারা জীবনে চারজন জীবন সঙ্গিনী প্রথম জন রুমা দেবী(১৯৫০-১৯৫৮), দ্বিতীয় জন মধুবালা দেবী (১৯৬০-১৯৬৯),যোগীতাবালী(১৯৭৫-১৯৭৮) এবং সবশেষে লীনা চন্দাভারকর(১৯৮০-১৯৮৭/আমৃত্যু)।

সারা জীবনে কিশোর কুমার গান রেকর্ড করেছেন হিন্দিতে (১১৮৮),বাংলাতে(১৫৬),উর্দু তে(১৩৫),তেলেগু ভাষায়(৮),ভোজপুরী (১১),মালয়ালাম(৬),অসমীয়া(২২),গুজরাটি(২০),ওড়িয়াতে(২৭),।এছাড়াও তিনি অসংখ্য রবীন্দ্র সঙ্গীতও গেয়েছেন। কিশোর কুমারের গাওয়া বহু গান এতো জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে যে তা যেন চিরকালীন সম্পদ হয়ে আছে,থাকবেও।

তিনি অনেক বার ফিল্ম ফেয়ার এওয়ার্ড পেয়েছেন,পেয়েছেন ৮ বার শ্রেষ্ঠ গায়কের সম্মান জাতীয় পুরস্কার হিসাবে।

তিনি বোম্বের,কলকাতার প্রায় সমস্ত সঙ্গীত পরিচালকের সঙ্গেই কাজ করেছেন,লক্ষ্মীকান্ত-প্যারেলাল,কল্যানজি-আনন্দজি,শচীন দেব বর্মন, রাহুল দেব বর্মন, হেমন্ত কুমার,বাপ্পী লাহিড়ী,অজয় দাস সহ আরও অনেক প্রথিত্যশা সঙ্গীত পরিচালক।

কিশোর কুমার অনেক চলচ্চিত্র নায়কের লিপেই গান করেছেন, যেমন,সুনীল দত্ত, মেহমুদ, দেবানন্দ,ধর্মেন্দ্র,শশী কাপুর,সঞ্জীব কুমার, অমিতাভ বচ্চন,রনধীর কাপুর,মিঠুন চক্রবর্তী,ঋষি কাপুর,সঞ্জয় দত্ত,প্রমুখ। বাংলায় উত্তম কুমার,সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, মিঠুন চক্রবর্তী, তাপস পাল,সুখেন দাস,প্রসেনজিৎ,প্রমুখ।

তিনি লতা মঙ্গেশকরের সুরে  বাংলা গান করেছেন,আবার তাঁর সুরেও লতা মঙ্গেশকর বাংলা গান করেছেন।

 কিশোর কুমার ছিলেন এক বিরল প্রতিভার মানুষ। এক অনন্য সাধারণ চরিত্র।

তাঁর শেষ ছবি “দূর বাগিয়োমে কহী..”। শেষ ফিল্ম মিউজিক ডাইরেকশন ” মমতা কি ছাঁও মে..”।কিশোর কুমারের শেষ গান… ” গুরু গুরু আ যাও শুরু…”(ওয়াক্ত কী আওয়াজ//মিঠুন চক্রবর্তী/১৯৮৮তে রিলিজ,কিশোর কুমারের চলে যাওয়ার পরে../গানটি আশা জীর সাথে ডুয়েট)।কিশোর কুমার শেষ রেকর্ড করেছিলেন মৃত্যুর দু-দিন আগে ১১ ই অক্টোবর,১৯৮৭ তারিখে।

দুদিন পরে ১৩ ই অক্টোবর।১৯৮৭ কিশোর কুমার বম্বেতেই চির বিদায় নিয়েছিলেন..তখন তিনি মাত্র ৫৮ বছরের।

আজও মনে হয় তিনি যে চিরন্তন আলোর বিন্দুতে।মিলিয়ে গেলেন শেষ বিদায় নিয়ে,যেতে যেতে যেন গেয়ে উঠছেন” চলতে। চলতে মেরে ইয়ে গীত, ইয়াদ রাখনা…কভি আলবিদা না কহে না “।

মন্তব্য করুন

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.