পঙ্কজ চট্টোপাধ্যায়
সিঙ্গাপুরের প্রাক্তন রাষ্ট্রদূত Mr. T.C.A. Raghavan-এর একটি ডায়েরি থেকে জানা যায় একটি অলিখিত ইতিহাসের হারিয়ে যাওয়া কাহিনি।
সময়টা ১৯৪৩ সালের অক্টোবর–নভেম্বর। আজাদ হিন্দ সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। স্বাধীন ভারতবর্ষের স্বাধীনতা উচ্চারিত হয়েছে। লক্ষ–কোটি প্রবাসী ভারতীয় বিশাল এক জনসভায় সমবেত হয়েছেন। তাঁদের মনে স্বাধীনতার বলিষ্ঠ অহঙ্কার, প্রাণের অঙ্গীকার।
সেই জনসভায় আজাদ হিন্দ বাহিনীর তহবিলে সাধ ও সাধ্যের মধ্যে থেকে দান করছেন প্রবাসী ভারতীয়রা— এমনকি অন্যান্য দেশের প্রবাসী মানুষও। তারা দেশকে ভালোবাসেন, মানুষের ন্যায্য দাবিকে সম্মান করেন।
তাদের মধ্যেই এক জন শিখ পাঞ্জাবি ভদ্রলোক তিনবার উচ্চারণ করে চেঁচিয়ে উঠলেন—“জয়হিন্দ, জয়হিন্দ, জয়হিন্দ!”
তিনি বললেন, “সিঙ্গাপুরে আমার দু’খানা বিরাট বাড়ি আছে, গ্যারেজে আটটি ট্রাক আছে, ব্যাঙ্কে তিরিশ–চল্লিশ লাখ ডলার জমা আছে। আমার যা কিছু আছে—শেষ কপর্দক পর্যন্ত—সব আজাদ হিন্দ ফান্ডে লিখে দিচ্ছি। কিন্তু তার বিনিময়ে ওই মালাটি শুধু আমার চাই, আমাকে দিন।”
এই কথাগুলি বলতে বলতে অঝোর ধারায় নেমে এসেছিল সেই বিরাট চেহারার শিল্পপতি মানুষটির চোখের জল। তাঁর নাম—হরগোবিন্দ সিং।
কিন্তু সেই মালাটি কার? কেন তা এত অমূল্য? কেন একটি মালার জন্য এক প্রবাসী ভারতীয় শিল্পপতি সেদিন তাঁর সমস্ত স্থাবর–অস্থাবর সম্পত্তি বিলিয়ে দিলেন? কেন নিঃস্ব হতে রাজি হলেন? কী সেই মালা? কার মালা?
প্রচুর মানুষের ভিড়ের মধ্যে থেকে মঞ্চে দাঁড়ানো সেই জ্যোতির্ময় পুরুষ— বলিষ্ঠ পদক্ষেপে নিচে নামলেন। অসংখ্য মানুষের ভিড় ঠেলে এসে দাঁড়ালেন সরাসরি হরগোবিন্দ সিং-এর সামনে।
দু’হাতে বুকে টেনে নিলেন তাঁকে, এবং বললেন, “আজ তো আপ হি বন গয়ে সর্দার, ক্যাপ্টেনজী। ইয়ে মহল কা, ইয়ে মকসদ কা, ইয়ে সওয়ালোঁ কা কোই জবাব নেহি।”
এই বলে তিনি নিজের গলার মালাটি খুলে হরগোবিন্দের গলায় পরিয়ে দিতে এগোলেন। বিস্ময়ে, আবেগে, অশ্রুসজল চোখে তাকিয়ে আছেন হরগোবিন্দ— তাঁর স্বপ্নের মানুষটির দিকে, লক্ষ–কোটি মানুষের নয়নমণি সেই মহামানবের দিকে।
সর্দারজী আবেশ কাটিয়ে আর্ত কণ্ঠে বলে উঠলেন, “না, না, না! আমার গলায় নয়! তাতে আমার গুনাহ হবে! পাপ লাগবে! মালাটি শুধু আমার হাতে দিন— আমি স্পর্শ করি, প্রণাম করি, চোখের জলে ধুই…”
সেই মহামানব—সন্ন্যাসী রাজাধিরাজ—তাই করলেন।
চারদিকে তখন লক্ষ মানুষের কণ্ঠে ধ্বনিত হচ্ছে—
“বন্দে মাতরম!”
“ইনকিলাব জিন্দাবাদ!”
“আজাদ হিন্দ জিন্দাবাদ!”
“নেতাজী সুভাষচন্দ্র বোস জিন্দাবাদ!”
“জয়হিন্দ!”
হরগোবিন্দ তখন নেতাজীর মুখের দিকে তাকিয়ে কৃতজ্ঞতায় বললেন,“আমাকে আর একটি ভিক্ষা দিন, নেতাজী…”
নেতাজী তাঁর কাঁধে হাত রেখে বললেন, “ভিক্ষা নয়, বলো হক। বলো, তোমার কী ইচ্ছা?”
হরগোবিন্দ হাত জোড় করে বললেন, “এখন তো আমি নিঃস্ব। গাছতলা ছাড়া দাঁড়াবার জায়গা নেই। দিনে একমুঠো গমও চাই পেটের জন্য। আপনি আমাকে আশ্রয় দিন… আজাদ হিন্দ বাহিনীতে ভর্তির অনুমতি দিন!”
সেদিন নেতাজী সুভাষচন্দ্র আবারও তাঁকে জড়িয়ে ধরলেন। নেতাজীর চোখের কোনে জল জমেছিল। নিজের হাতে হরগোবিন্দের চোখের জল মুছিয়ে দিতে দিতে বললেন, “আমি যদি একখানা রুটি খেতে পাই, তবে তার অর্ধেক তোমার সাথে ভাগ করে খাব। তুমি আমার দেশমাতৃকার সন্তান। আজ থেকে তুমি আজাদ হিন্দের ক্যাপ্টেন— ক্যাপ্টেন হরগোবিন্দ সিং।
ব্রিটিশ আমার পিছু নিয়েছে— হয়তো একদিন আমি থাকব না। কিন্তু তোমরা থাকবা। তোমাকে থাকতেই হবে— আজাদ হিন্দের জন্য, স্বাধীন ভারতের জন্য, মানুষের জন্য।”
এই কথা বলে নেতাজী সামরিক কায়দায় স্যালুট জানালেন সর্দার হরগোবিন্দ সিং-কে। হরগোবিন্দ আপ্লুত, অশ্রুসিক্ত, আর বুকভরা সিংহতেজে দীপ্ত।
সেই মুহূর্তে সমাবেশের ময়দান কাঁপিয়ে আবার ধ্বনিত হয়েছিল—
“জয়হিন্দ! জয়হিন্দ! জয়হিন্দ!”
“আজাদ হিন্দ জিন্দাবাদ!”
“নেতাজী সুভাষ বোস জিন্দাবাদ!”
নেতাজী একজনই—
নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু।
সময়ের স্রোতে এক বিশ্বব্যাপী রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের ফলে নেতাজী হয়ে গেলেন অজানা পথের পথিক। হারিয়ে গেলেন তিনি।
আর হরগোবিন্দ সিং-এর মতো ত্যাগী দেশপ্রেমিক সিঙ্গাপুরে চরম দারিদ্র্যের মধ্যে জীবন কাটালেন।
তিনি আর কোনওদিন তাঁর প্রাণের মানুষ—নেতাজী বিহীন ভারতবর্ষে—ফিরে আসেননি।
এই কাহিনি আজও নীরব, উপেক্ষিত, অলিখিত ইতিহাসের পাতায় লুকিয়ে আছে।
আমাদের ভারতবর্ষের দুর্ভাগ্যের শুরু যেন সেখানেই।