পঙ্কজ চট্টোপাধ্যায়
রেভারেন্ড কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়ের কন্যা চিনতে পারেননি কবিকে, তাই প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। না–রেবেকা মেস্টেভিসও বুঝতে পারেননি কবিকে, তাই সংসার করেও, ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন কবিকে।
তখন কবি নিঃস্ব নিঃসঙ্গ। ঝড়ের আহত পাখি যেন কবি। ১৯৪৮ সাল– কবির এই কলকাতাতেই পরিচয় হল এক ইংরেজ মহিলার সঙ্গে, নাম– হেনরিয়েটা (Henrietta Phyllis Fancit Dutton)। পরিচয় হয়েছিল ইংরেজি সাহিত্য, নাট্যচর্চা ইত্যাদি আলোচনার পরিবেশে।
তারপর শুরু হয় প্রেম। সমাজ অনেক কথা বলতে লাগলো। কবি কিন্তু Don’t care…। মধুসূদন ভালোবাসলেন হেনরিয়াটা-কে।কাছে টেনে নিলেন। গ্রহণ করলেন স্ত্রী হিসাবে। কিন্তু তখনকার হিন্দু সমাজ, ইংরেজ সমাজ উভয়েই শুরু করল চরম বিরোধিতা। কিন্তু কবি ছিলেন সাহসী। পরোয়াই করলেন না সেসব। হেনরিয়েটার ভালোবাসায় তখন মধুসূদন নতুন করে কবিতা, নাটক লিখছেন। এই বিষয়ে কবি পরে লিখেছিলেন–“I have in her more sincerity, more affection, than in all the relations I lost…”।
এ যেন প্রেম নয়, এ যেন এক বিপ্লবের কবিতা। একদিকে অভাব,অপরদিকে গভীর,নিবিড় প্রেম –এই ছিল কবি শ্রীমধুসূদন এবং হেনরিয়েটার সংসার। তিন সন্তান — মিল্টন, হেনরি, শর্মিষ্ঠা।
মাইকেলের অস্থির, অনিশ্চিত জীবনের সাথে পরম আদরে, সাদরে, ভালোবেসে নিজের জীবনকে জড়িয়েছিলেন হেনরিয়েটা। চরম দারিদ্র্যতা, নিঃসঙ্গতা,অপমান, অবহেলা সহ্য করেও বাংলা ভাষার মহাকবিকে আগলে রেখেছিলেন এই হেনরিয়েটা।
কখনো ফ্রান্সে, বা বিদেশের কোনওখানে, বা কখনো এই কলকাতায় হেনরিয়েটাকে একা একা সংসার এবং সন্তানদের কিভাবে সামলেছেন, তা এক অনন্যসাধারণ দৃষ্টান্ত। বাঙালি সমাজ, ইংরেজ সমাজ কেউই সেদিন সাহায্য,সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়নি।একমাত্র কয়েকজন ছাড়া। যেমন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয়,মাইকেলের বাল্যবন্ধু গৌর বসাক, ভুদেব মুখোপাধ্যায় প্রমুখরা ছাড়া।
মাইকেল তখন ফ্রান্সে।হেনরিয়েটা কলকাতায়। একা একা সন্তান সহ সংসার সামলাচ্ছেন দারিদ্র্যের মধ্যে দিয়ে, কলকাতার এক জরাজীর্ণ এঁদো গলির মধ্যে স্যাঁতসেঁতে ভাড়া ঘরে।
দিনের পর দিন এইভাবে চলায় হেনরিয়েটা সন্তানদের তার বাপের বাড়ি ইংল্যান্ডে পাঠিয়েদিলেন। নিজে রইলেন একা এই কলকাতায় মাইকেল মধুসূদন দত্তের অপেক্ষায়।
কিন্তু অপুষ্টি, নিঃসঙ্গতা, দারিদ্রতা, এইসবের ফলশ্রুতিতে হেনরিয়েটা দুরারোগ্য ব্যাধি যক্ষা রোগে আক্রান্ত হলেন। ভর্তি করা হোল ক্যাম্বেল হাসপাতালে, (এখনকার আরজি কর হাসপাতাল)।
ইতিমধ্যে মাইকেল মধুসূদনও চলে এসেছেন কলকাতায়। হেনরিয়েটার দেখা পেলেন না। হেনরিয়েটা তখন হাসপাতালে শয্যাশায়ী। এর কয়েকদিন পরে হেনরিয়েটা চলে গেলেন চিরতরে। মাইকেলের সাথে শেষ দেখাও হল না।
এদিকে মাইকেলও তখন অসুস্থ,হেনরিয়েটার মৃত্যুর খবর পেয়ে তিনি আরও ভেঙে পড়লেন। তিনি লিখলেন–“She is gone. And I have no more to lose…” (সে চলে গেছে। আমার আর হারানোর কিছু নেই..)।
হেনরিয়েটার অনুপস্থিতি মাইকেলের মনে এক গভীর শূন্যতার জন্ম হয়েছিল। মাইকেলের লেখায়,কবিতায়, চিঠিপত্রে, আত্মদহনে বারবার ফিরে ফিরে এসেছে সেই নিঃসঙ্গ নারীর স্মৃতি। মাইকেল লিখলেন–” তুমি যাহা দাও,তাহা লও।/ আমি শুধু স্মৃতির মালা বুনে যাবো”।
মাইকেল মধুসূদন দত্তের এই স্মৃতির মালায় হেনরিয়েটা ছিলেন মধ্য-মণিরত্ন। যাকে মেনে নেয়নি সমাজ, করেছে অপমান, করেছে অবহেলা,–ইতিহাস মনে রাখে তাকে–কবির হৃদয়ে হেনরিয়েটা তাই ছিলেন চিরন্তনীয়া– একমাত্র ভালোবাসার মরমীয়া–দরদীয়া নারী।
প্রেম, দারিদ্র্য, নিঃসঙ্গতায় আসঙ্গ এক নারী –যিনি এই কলকাতার কোনও এক জরাজীর্ণ গলিতে পড়ে থাকতেন দিনের পর দিন অপমানিতা, অবহেলিতা,অভুক্ত, হয়ে–তিনিই ছিলেন মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের প্রাণের প্রতিমা।মননের জন্মভুমি হেনরিয়েটা না থাকলে মধুসূদন দত্তের কবিতা, নাটক, জীবনচিত্র, এমন হৃদয়-বিদারক হয়ে উঠত না।
মাইকেল মধুসূদন দত্তের জীবনে হেনরিয়েটা ছিলেন –প্রেমিকা, সমাজকে অগ্রাহ্য করা এক সাহসী ভালোবাসার মানুষ, জীবনসঙ্গিনী।যিনি সমস্ত প্রতিবন্ধকতা সহ্য করেও একান্ত ভালোবেসেছিলেন মহাকবিকে,-নীরবে, নিভৃতে, নিবিড় করে। সেখানে এই হেনরিয়েটা যেন এক বেদনার বিষন্নময়ী দেবী প্রতিমা।
ইতিহাস কি ভুলতে পারে? না পারে না। যেমন পারেননি মহাকবি, তাই তো হেনরিয়েটার সমাধির পাশেই মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের ইচ্ছানুযায়ী সমাধি আজও আমাদের মনে করিয়ে দেয়,তাদের অমর প্রেম,অক্ষয় ভালোবাসা।
পাশাপাশি ঘুমিয়ে আছেন পার্ক স্ট্রিটের কাছে মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত এবং কবির ভালোবাসা হেনরিয়েটা। মাইকেল মধুসূদন দত্তের প্রাণেশ্বরী…।
কান পাতলে শোনা যাবে হয়তো…” দাঁড়াও পথিকবর, জন্ম যদি তব বঙ্গে, তিষ্ঠ ক্ষণকাল…”।
হয়তো শোনা যেতে পারে মাইকেলের অনেক পরে জন্ম নেওয়া জোড়াসাঁকোর সেই কবির গানের সুর–“আমি তোমার প্রেমে হবো সবার কলঙ্কভাগী,সকল দাগে হবো দাগী,কলঙ্কভাগী…”।
বাংলা সাহিত্য চিরকাল ঋণী হয়েই থাকবে হেনরিয়েটার কাছে, মাইকেল মধুসূদন দত্তের জন্যে।