ভারতমাতার এক বিস্মৃত অগ্নিসন্তান: চন্দ্রশেখর আজাদ

পঙ্কজ চট্টোপাধ্যায়

“সরফরসি এ তামান্না অব্ হামারে দিলমে হ্যায়..”- এই ছিল সেই দৃঢ়চেতা মানুষটির শেষ উচ্চারন। ভারতমাতার সেই বীর সন্তানের নাম,বীর পুত্তরের নাম চন্দ্রশেখর আজাদ।
আসল নাম ছিল চন্দ্রশেখর তিওয়ারি। মা ছিলেন জাগরনী দেবী,বাবা ছিলেন সীতারাম তিওয়ারি। চন্দ্রশেখরের জন্ম ১৯০৬ সালের ২৩শে জুলাই,মধ্যপ্রদেশের আলিরাজপুরের ভাওরা গ্রামে।
স্থানীয় স্কুলের পাঠ শেষ করে তিনি ১৯২১ সালে বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন।তার কিছুদিন আগেই ঘটে গেছে ১৯১৯ সালের জালিয়ানওয়ালা বাগের সেই ভয়ংকর, মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ড। চন্দ্রশেখরের কিশোর মনে জ্বলজ্বল করছে সেই ক্ষত। তিনি যুক্ত হলেন গান্ধীজির অসহযোগ আন্দোলনে। গ্রেপ্তার হলেন। ম্যজিস্ট্রেটের সামনে নিজের নামের পদবি বললেন ” আজাদ” অর্থাৎ “মুক্ত”।সেই থেকেই তিনি চন্দ্রশেখর আজাদ নামে পরিচিত হন।
গান্ধীর নিরীহ আর দোদুল্যমান অসহযোগ আন্দোলনে তার মন টিকলো না।তিনি ততদিনে বিপ্লবী সংগঠন হিন্দুস্তান রিপাবলিকান এসোসিয়েশনের প্রতিষ্ঠাতা রামপ্রসাদ বিসমিল,আশফাকুল্লাহ্ খান,রাজেন্দ্রনাথ লাহিড়ী,শচীন সেন,মৃন্ময়গুপ্ত,চান্দোল সিং, প্রমুখদের সঙ্গে পরিচিত হন,এবং তিনি সেই সংগঠনের দেশের স্বাধীনতার আন্দোলনের কাজের জন্য নিজের জীবনও উৎসর্গ করেন।
১৯২৫ সালে বিপ্লবী আশফাকুল্লাহ খান,রামপ্রসাদ বিসমিল,রাজেন্দ্রনাথ লাহিড়ী র পরিকল্পনায় কাকোরি ট্রেন লুন্ঠনের কাজে যুক্ত হন। ১৯২৭ সালে স্বাধীনতা আন্দোলনের “লাল-বাল-পাল” খ্যাত (লালা লাজপৎ রায়,বাল গঙ্গাধর তিলক,বিপিনচন্দ্র পাল) অন্যতম নেতা লালা লাজপৎ রায়ের প্রতি ব্রিটিশ সরকারের নির্মম অত্যাচার এবং আলা লাজপৎ রায়ের মৃত্যুতে আর বদলা নিতে চন্দ্রশেখর আজাদ ব্রিটিশ পুলিশ অফিসার J.P.Sanders-কে গুলি করে হত্যা করেন। তারপর তিনি আত্মগোপন করে ফেরার হয়ে যান। পরে তিনি পাঞ্জাবের ভগৎ সিং, রাজগুরু,প্রমুখদের সাথে পরিচিত হন। তখন চন্দ্রশেখর আত্মগোপন করে রয়েছেন ঝাঁসীতে। সেখানে তিনি হরিশঙ্কর ব্রহ্মচারী ছদ্মনামে বিপ্লবীদের ব্রিটিশের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের প্রশিক্ষণের দায়িত্বে ছিলেন। তাঁর কাছে প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন ভগৎ সিং,রাজগুরু,প্রমুখ ভারতমাতার বীর সন্তানরা।
চন্দ্রশেখর আজাদ ব্রিটিশ সরকারের রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছিলেন। ব্রিটিশ পুলিশ তাঁকে ধরার জন্য হন্যে হয়ে ঘুরে মরেছিল। তার মাথার দাম এক লক্ষ টাকা ঘোষণা করেছিল ব্রিটিশ সরকার।কিন্তু চন্দ্রশেখর ছিলেন ধরা ছোঁয়ার বাইরে।
তিনি তাঁর পরিচিতদের বলতেন, যে তিনি কিছুতেই ব্রিটিশ সরকারের কাছে জীবন থাকতে ধরা দেবেন না।

সেই প্রতিজ্ঞা তিনি রেখেছিলেন। এলাহাবাদের তখনকার আলফ্রেড পার্কে (এখন চন্দ্রশেখর আজাদ উদ্যান) ব্রিটিশ পুলিশের সাথে লড়াই করার সময়ে একেবারে অন্তিম মুহূর্তে চন্দ্রশেখর আজাদ নিজের রিভলবারের শেষ গুলিটি নিজের মাথায় চালিয়ে দেন,এবং অপরাজিত বীর শহীদের বীরগতি লাভ করেন। সেইদিনটি ছিল ২৭ শে ফেব্রুয়ারী, ১৯৩১ সাল।

ভারতমাতার মুক্তিযুদ্ধের সেইসব আত্মবলিদানের অমর বীর সন্তানদের খবর এখনকার ডিজিটাল ইন্ডিয়া কি রাখে? বোধহয় রাখে না। কিন্তু আমরা জানি, যে অতীতকে ভুলে যাওয়া,স্মরণ না করা মানে নিজেদের অস্তিত্বের শিকড়কে ভুলে যাওয়া। সেটা আমাদের সংস্কৃতির ঐতিহ্য বা পরম্পরা নয়।

Related posts

‘মহিষাসুরমর্দিনী’- কিছু অজানা কথা

‘ইন্ডিয়া দ্যাট ইজ ভারত’, কিছু ঐতিহাসিক তথ্য

তিনিই ছিলেন একমাত্র “ঐক্যপুরুষ”