পঙ্কজ চট্টোপাধ্যায়
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সৃষ্টিতে পাই, “ঘরে ঘরে ডাক পাঠালো,দীপালিকায় জ্বালাও আলো, জ্বালাও আলো, জ্বালাও আলোর দীপগুলিরে..,জ্বালাও আলোর জয়বাণীরে…”।
দীপাবলি–দীপালি– দিওয়ালি–যে নামেই এই উৎসবকে সম্বোধন করা হোক না কেন, আসলে, এই উৎসবের নামের মাহাত্ম্য নিয়ে হল “দীপ উৎসব”, দীপদান উৎসব। এই উৎসব সারা ভারতের, এমনকি ভারতের বাইরেও এই উৎসব পালিত হয়।
দশেরায়, মানে দুর্গাপূজার বিজয়াদশমীর তিথিতে রাবণ বধের পরে রামচন্দ্রের অযোধ্যায় ফিরে আসাকে কেন্দ্র করে প্রাচীন ভারতবর্ষের বিভিন্ন স্থানে প্রদীপ জ্বালিয়ে, মশাল জ্বালিয়ে যে বিজয় উৎসব পালিত হয়েছিল, সেটাই বোধহয় কালক্রমে দীপাবলি বা দিওয়ালি উৎসব হিসাবে পালন করা হয়ে আসছে যুগে যুগে।

রামায়ণে এই দীপাবলির উল্লেখ আছে। আবার পুরাণ মতে, পিতৃপক্ষের শেষে মহালয়াতে পিতৃতর্পণে শ্রদ্ধা নিবেদনের ক্রিয়াকর্মতে যোগদান বা উপস্থিতির জন্য যমলোক থেকে আগত সকল পিতৃপুরুষদের আবার যমলোকে ফিরে যাওয়ার জন্যই না কি কার্তিক মাসের এই অমাবস্যা তিথিকে নির্বাচন করা হয়, আর তাই এ দিন সেইসব বিদেহী পূর্বপুরুষদের প্রত্যাবর্তন যাতে সুষ্ঠুভাবে হয়, তাই এ দিন দীপাদান এবং উল্কাবাজি জ্বালানোর প্রচলন বা কথা উল্লেখ রয়েছে। এর থেকেই বোধহয় দীপাবলি বা দিওয়ালির দিনে আতসবাজি জ্বালানোর রীতি শুরু হয়। সেসব বহু বহু প্রাচীনকালের কথা।
“দীপাবলি”-র মানে হল প্রজ্জ্বলিত প্রদীপ বা দীপশলাকার সমষ্টি। অন্ধকার, অমঙ্গল এবং অশুভ যা কিছু,তাকে দূর করতেই এই প্রথার উৎসবের সৃষ্টি হয়েছে বলেও ঐতিহাসিকরা মনে করেন।
কথিত আছে, তথাগত বুদ্ধদেবের রাজগৃহ ত্যাগ এবং বুদ্ধদেবের অন্যতম প্রিয় শিষ্য মহা-মোগ্গলায়ন-এর মহাপরিনির্বাণ উপলক্ষে বৌদ্ধরা এই উৎসব প্রথম পালন করেছিলেন খ্রিস্টপূর্ব ৬৭০ অব্দে।
আবার জৈন মতে, জৈনমতের অন্যতম মহামহিম তীর্থঙ্কর মহাবীর বর্ধমান ৫২৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দে এই কার্তিক মাসের কৃষ্ণা চতুর্দশী তিথির রাতে দীপাবলির দিনেই মহানির্বাণ লাভ করেছিলেন। তাই সারাবিশ্বে বৌদ্ধদের মতো জৈনরাও এই দিনটিকে দীপমালাসজ্জিত করে পালন করেন। শিখ ধর্মের অনুসারীরাও এই দীপাবলি উৎসব পালন করেন। কারণ, ১৫১৯ খ্রিস্টাব্দে শিখদের ষষ্ঠ গুরু হরগোবিন্দ্ এবং ৫২ জন শিখ শিষ্য মুক্তিলাভ করেছিলেন বন্দি অবস্থা থেকে। তাই শিখেরা এই দীপাবলির উৎসবকে “বন্দিছোড়্” দিবস হিসাবেও পালন করেন।
মহাভারতে উল্লেখ আছে আদিপর্ব -তে, যে এই কার্তিক মাসের এই অমানিশার দিনে শ্রীকৃষ্ণ প্রজাজ্যোতিষপুরের (এখনকার অসম) অধিপতি নৃকাশ্বর (অপভ্রংশ তে নরকাসুর/ যে বিষ্ণুর বরাহরূপ অবতার এবং ধরিত্রীর সন্তান) বধ করে ষোল হাজার বন্দি বন্দিনীকে শ্রীকৃষ্ণ উদ্ধার করেন বন্দিদশা থেকে। এই নরকাসুরকে বধ করার জন্যই এইদিন আনন্দে দীপশলাকা প্রজ্জ্বলিত করা হয়।
ইতিহাস থেকে জানা যায় সম্রাট অশোক কলিঙ্গ যুদ্ধের পরে অনুশোচনায় অনুতপ্ত হয়ে শান্তি আর মৈত্রীর জন্য নিজেকে নিয়োজিত করতে এই দীপাবলির দিন বৌদ্ধধর্মতে দীক্ষিত হয়েছিলেন।
দীপাবলির এই উৎসব সারা ভারতে পালিত হয়। পালিত হয় ভারতের বাইরেও,এশিয়ার বিভিন্ন দেশে। পালিত হয় ইউরোপীয় কয়েকটি দেশেও। চিন, তাইওয়ান, মায়ানমার, তিব্বত, জাপান, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, কোরিয়া, ভিয়েতনাম, প্রভৃতি দেশে এই উৎসব পালিত হয়। আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়াতেও এই উৎসব পালিত হয়। কোথাও এই উৎসব লাইট কার্নিভ্যাল নামে, কোথাও ল্যান্টার্ন ফেস্টিভ্যাল নামে, কোথাও লাইট ইন ইভ, নামে পরিচিত। প্রাচীন গ্রিক সভ্যতাতে এই উৎসব “লাইট ইন নাইট” নামে প্রচলিত ছিল। মিশরীয় সভ্যতাতে ফারাও-রা এই উৎসব কে বলতেন “এলিয়েন” ফেস্টিভ্যাল।
রাজস্থান-সহ পশ্চিম ভারতে দীপাবলির উৎসবকে ধনতেরাস উৎসব হিসাবে কুবের এবং মহালক্ষীর পুজো করা হয়। পঞ্জাবে লক্ষীনারায়ণ, মহাকালীর পুজো করা হয়। উত্তরপ্রদেশ, মধ্য প্রদেশে, ছত্তীসগঢ়ে কালীমা, কুবের এবং মহালক্ষীর পুজো হয়। দক্ষিণ ভারতে এইদিন কালীকৃষ্ণাম্মা এবং মহালক্ষীদেবীর পুজো হয়। পূর্ব ভারতে বাংলা-সহ সব রাজ্যেই কালীমা, শ্যামা মায়ের পুজো করা হয়। পুজো করা হয় মহালক্ষীর, যাকে দীপাণ্বিতা লক্ষীপুজা বলা হয়।

মানব সভ্যতার ইতিহাসে এই দীপাবলি উৎসব সুপ্রাচীন এক উৎসব। সকলের জন্য শুভকামনা এবং শুভাকাঙ্ক্ষীতাই হল এই উৎসবের প্রধান মৈত্রী এবং সম্প্রীতির আলোকোজ্জ্বল সবার মনের মাধুরী মেশানো এক রংবেরঙের বর্ণচ্ছ্বটা।
সকলকে শুভ দীপাবলির শুভেচ্ছা। ভালো থাকবেন।