প্রথম পাতা প্রবন্ধ “পরমবীর চক্র” এবং এক অজানা ইতিহাস

“পরমবীর চক্র” এবং এক অজানা ইতিহাস

1.6K views
A+A-
Reset

পঙ্কজ চট্টোপাধ্যায়

আমদের ভারতবর্ষের সর্ব্বোচ্চ সামরিক সম্মান হোল “পরমবীর চক্র”। আমরা যখন পরম নিশ্চিন্তে রাতে পরিবারের সকলের সাথে ঘুমাই,তখন যারা তাদের পরিবারের প্রিয়জনদের ছেড়ে অনেক অনেক দূরে দেশকে রক্ষা করতে,দেশের মানুষের নিশ্চিন্ততাকে রক্ষা করতে, রাত জেগে পাহারা দেয় আমাদের দেশের সীমান্তরেখা। কখনো যদি শত্রুরা আক্রমণ করে তখন নিজেদের জীবনকে বাজি রেখে শত্রুর চোখে চোখ রেখে লড়াই করে,দেশের সম্মানকে মজবুত করে। হ্যাঁ, তারাই হলেন আমাদের সামরিক বাহিনী বীর সেনানী।

এই কাজে অকালে অনেকের প্রাণ যায়।নিজেদের প্রাণকে তুচ্ছ করে,অষ্টপ্রহর দেশের সেবায় নিয়োজিত সেই সামরিক সেনা বাহিনীর বীর সন্তানদের অতুলনীয় সাহস,আত্মত্যাগের প্রতি দেশের মানুষের হোয়ে দেশের সরকারের প্রথম ব্যক্তি মাননীয় রাষ্ট্রপতি এই সম্মান প্রদান করেন। এই পদকের সমতুল্য সম্মানীয় পদক হোল আমেরিকাতে ” মেডেল অফ অনার”, বা ইংল্যান্ডের “ভিক্টোরিয়া ক্রস”।

আমাদের দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে ১৯৫০ সালের ২৬ শে জানুয়ারী ” প্রজাতন্ত্র দিবস” থেকে এই সম্মান প্রদান শুরু হয়।আর এই সম্মানের কার্যকাল হিসাবে ১৯৪৭ সালের ১৫ ই আগষ্ট অর্থাৎ স্বাধীনতার প্রথম দিন থেকেই ধরা হয়।

সামরিক বাহিনী(স্থল), নৌ-বাহিনী,বিমান বাহিনী, সংরক্ষিত বাহিনী, সীমান্ত রক্ষী বাহিনী সমুদয় বাহিনীর মহিলা এবং পুরুষকে বীরত্ব,সাহসিকতার এবং আত্মত্যাগের জন্য এই সম্মান প্রদান করা হয়।

সেই ১৯৫০ সাল থেকে আজ ২০২১ সাল অবধি এই শ্রেষ্ঠ সামরিক সম্মান পেয়েছেন মাত্র ২১ জন।তাঁদের মধ্যে মরনোত্তর ভাবে পেছেন ১৪ জন। এই সম্মান প্রথম পান মরনোত্তর ভাবে ফোর্থ ব্যাটেলিয়ান কুমায়ুন রেজিমেন্টের মেজর.. মেজর সোমনাথ শর্মা।তিনি সদ্য দেশ স্বাধীন হবার পরেই ১৯৪৭ সালের ৩রা নভেম্বর পাকিস্তানের আক্রমন থেকে কুমায়ুন এলাকার মানুষদের প্রান রক্ষা সহ দেশের সম্মান রক্ষা করতে গিয়ে প্রান হারান।

শৌর্য এবং বীরত্বের মহিমা নিয়ে এই সম্মান পদক তৈরীর পিছনে রয়েছে এক ভালোবাসার কাহিনি

একটি ১৬ বছরের তরুণী।না, এ দেশের নয়,সুইজারল্যান্ডের।নাম ইভ্ ইভোন্নে ম্যাডেই ডি মারোস। জন্ম ১৯১৩ সালের ২০ শে জুলাই,সুইজারল্যান্ডের নেউচাতেল-এ।বাবার নাম আন্দ্রে ডি ম্যাডেই,হাঙ্গেরীয়ান,অধ্যাপক,আর মায়ের নাম ম্যারেথ হ্যান্টজেল মারোস,রাশিয়ান,শিক্ষয়িত্রী।মা মারা যান ইভের শৈশবেই,তাই বাবাই তার সব।সে ভিয়েনার কাছে রিভেরার স্কুলে পড়াশোনা করতো আর বাকি সময় কাটতো বাবার সাথে লীগ অফ নেশন্সের লাইব্রেরীতে।বাবার সাথে সব রকমের বই পড়তো।এই পড়তে পড়তেই ইভের ভারতবর্ষ সম্মন্ধে কৌতুহল জন্মায়,দেশটাকে জানার,চেনার জন্য।
তার যখন ১৬ বছর বয়স, তখন সে এক শীতের সকালে তার বাবার সাথে আর অন্যান্য বন্ধুদের সাথে রিভেরার সমুদ্র সৈকতে ছুটি কাটাচ্ছে,সেই সময়ে তার সঙ্গে পরিচয় হয় এক ভারতীয়ের…তার নাম বিক্রম রামজী খানোলকার,সে বৃটিশ রয়াল মিলিটারি একাডেমীর সানহার্স্ট-এ ট্রেনিং প্রাপ্ত একজন ক্যাডেট।সেও ছুটি কাটাতে এসেছে সুইজারল্যান্ডে।

যাইহোক,দুজনের অবস্থা তখন “love at first sight” প্রথম দেখাতেই ভালোবাসা।
বাবাকে ইভ বললেন,সে বিক্রমকে বিয়ে করতে চান।বাবা রাজী হলেন না।কারন, মা-হারা একমাত্র কন্যা,সে চলে যাবে ইন্ডিয়া?কতোদুর সে দেশ??!

কিন্তু মেয়ে নাছোড়বান্দা।শেষে তিন বছর পরে১৯৩২ সালে ইভ এলেন বিক্রমের সাথে ভারতে। লখনৌতে বিশুদ্ধ মারাঠি হিন্দু রীতি মেনে বিয়ে হোল।ইভ গ্রহন করলেন হিন্দু ধর্ম, নাম হোল
” সাবিত্রী বাঈ খানোলকার।”

১৯৩২ সালে ইভ এলেন বিক্রমের সাথে ভারতে। লখনৌতে বিশুদ্ধ মারাঠি হিন্দু রীতি মেনে বিয়ে হোল।

শুরু করলেন সংস্কৃত,হিন্দী,মারাঠি ভাষা শিক্ষা। এদেশের সংস্কৃতিকে জানার আন্তরিক অভ্যাস শুরু করলেন।অনুপ্রানিত হলেন স্বামী বিবেকানন্দ,ভগিনী নিবেদিতা,কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ,নেতাজী সুভাষচন্দ্র,মহাত্মা গান্ধী,ছত্রপতি শিবাজি, প্রমুখদের দ্বারা। কবিগুরুর শান্তিনিকেতনে এলেন,দেখলেন,জানলেন।বিখ্যত নৃত্যশিল্পী উদয় শঙ্করের কাছে শিখেছিলেন ভারতীয় নৃত্য। তিনি ইংরাজিতে সেন্টস অফ মহারাষ্ট্র,এবং সংস্কৃত অভিধান নামে দুটি বই লেখেন।

ছোটবেলা থেকেই ইভ তথা সাবিত্রী খুব ভালো চিত্রশিল্পী ছিলেন।সুইজারল্যান্ডের পাহাড়,নদী,ঝর্ণা তার ভাল লাগতো,ভালো লাগতো প্রকৃতির নির্জনতা,নৈসর্গিকতা। ভারতেও তাই তিনি খুঁজে নিয়েছিলেন শান্তিনিকেতন,বেলুড়মঠ,সবরমতি আশ্রমের শান্ত-স্নিগ্ধ নিবিড়তাকে। তিনি নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভারতীয় কালচার নিয়ে ডিগ্রী লাভ করেন।

দেশ স্বাধীন হোল ১৯৪৭ সালে। দেশে নতুন ব্যবস্থা।ঠিক সেই সময়ে বিক্রম খানোলকারের সামরিক বাহিনীর মেজর জেনারেল হীরালাল অটল, যিনি ইতিমধ্যেই সাবিত্রী দেবীর ভারত প্রেম এবং এদেশের বিভিন্ন বিষয়ের প্রতি তাঁর জ্ঞান পিপাসা আর সেই সব ব্যাপারে প্রাজ্ঞতার কথা শুনেছেন,সেই হীরালাল অটল বিক্রম রামজী খানোলকারকে অনুরোধ করলেন যে প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী সরদার বল্লভ ভাই প্যাটেলের পরিকল্পনা মতো যে সামরিক সম্মানের কথা চলছে,সেই সম্মানের যে পদকটি করা হবে তার নকশা যেন বিক্রমজীর স্ত্রী সাবিত্রী দেবী করে দেন। যথারীতি,এই অনুরোধের কথা শুনে সাবিত্রী দেবী শুরু করে দিলেন সামরিক সম্মান “পরমবীর চক্র”-এর নকশা তৈরীর কাজ।

সাবিত্রী দেবী সেই নকশাটিতে নিয়ে এলেন ভারতীয় পুরানের দধিচী মুনির উপাখ্যান। নিজের অস্থি দিয়ে বৃত্রাসুরের মতো অশুভ শক্তিকে ধ্বংস করার জন্য দেবরাজ ইন্দ্রকে দধিচী মহামুনি বলেছিলেন,তৈরী হয়েছিল বজ্রায়ুধ, মহাঋষির সেই আত্মত্যাগ এবং আত্ম-বলিদানের কথা স্মরন করেই সাবিত্রী দেবী পদকের নকশাতে রাখলেন চারটি বজ্রের প্রতিকৃতি,মাঝখানে অশোকচক্র।
নকশা দেখে সবাই খুশী।শুরু হোল এক ইতিহাস।” ব্রোঞ্জের তৈরী পদকে বজ্রগুলি সোনার পাত দিয়ে মিনে করা,পদকের পেছনে লেখা পি.সি. মানে “পরিমবীর চক্র” পদকের রিং-এ লাগানো হল গোলাপী রঙের রিবন।

এরপর জওহরলালের অনুরোধে সাবিত্রী দেবী মহাবীর চক্র শৌর্য পদক,বীরচক্র শৌর্য পদক,অশোকচক্র শৌর্য পদক,কীর্তি শৌর্য পদক, গুলির নকশাও তৈরী করেন। সাবিত্রী দেবী দেশভাগের সময়ে বাস্তুচ্যুত হওয়া সেনা পরিবারদের এবং অন্যান্য শরনার্থীদের জন্য দীর্ঘদিন সেবা মূলক কাজ করেছেন নিরন্তর ভাবে।

সাবিত্রী দেবীর দুই কন্যা কুমুদিনী এবং মৃণালিনী।

১৯৫২ সালে বিক্রম রামজি খানোলকার মারা যান।তারপর সাবিত্রী দেবী সমস্ত সম্পত্তি শ্রী রামকৃষ্ণ মিশনকে দিয়ে দেন এবং দার্জিলিং -এর শ্রীরামকৃষ্ণ মঠে চলে যান। সেখানেই তিনি তার মেয়ে
মৃণালিনীর সাথেই শেষ জীবনটি কাটান। সাবিত্রী দেবী মারা যান ১৯৯০ সালের ২৬ শে নভেম্বর।
ভারতবর্ষের এই মাটিতে যুগে যুগে ভিন্ন দেশের মানুষ এসেছেন এই দেশকে ভালোবেসে,মায়ের মতো এই ভারতবর্ষও তাকে দিয়েছে নিজের কোল,দিয়েছে আশ্রয়,দিয়েছে ভালোবাসা।বিশ্বকবির কথায়..” হে মোর চিত্ত পূণ্য তীর্থ, জাগোরে ধীরে,এই ভারতের মহামানবের সাগর তীরে।”

মন্তব্য করুন

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.