পঙ্কজ চট্টোপাধ্যায়
বাঙালির বারোমাসে তেরো পার্বণের অন্যতম এক পার্বণ হল রবীন্দ্রনাথের জন্মদিন। এই বাংলা ও বাঙালি সারাবছর রবীন্দ্রনাথের চর্চার সাথে ওতোপ্রোতোভাবে সংযুক্ত থেকেও এই পঁচিশে বৈশাখের জন্য প্রার্থনা করে গেয়ে ওঠে বাংলা এবং বাঙালি –“হে নূতন দেখা দিক আর বার জন্মেরও প্রথম শুভক্ষণ..। “
পঁচিশে বৈশাখের শহরের, পঁচিশে বৈশাখের গ্রাম বাংলার সারা শরীরের অনুভবের তন্ত্রীতে তন্ত্রীতে, মনের একতারায়, দোতারায় থাকেন রবীন্দ্রনাথ। থাকে রবীন্দ্র-সুরের স্বরগম, মূর্ছনা। সেই রবীন্দ্রনাথ, যিনি আমাদের রক্তধারায় সুর ও বাণীর ছন্দ,তান সঞ্চারিত করে দেন পরম্পরাগতভাবে। আমাদের জন্মের আগেও তিনি,জন্মের পরেও তিনি থাকেন বন্ধুর মতো, আমাদের “জীবন মরণের সীমানা ছাড়ায়ে…’।
কতটুকুই বা জানি রবীন্দ্রনাথের সম্বন্ধে? তাঁকে জানা তাই বোধহয় আমাদের ফুরাবে না। তবু বলা যায় সেই জানতে চাওয়ার মাঝেই,চিনতে চাওয়ার মধ্যেই,খুঁজে যাই তাঁকে, বুঝতে চাই,জানতে চাই,চিনতে চাই রবি ঠাকুর-কে। আমাদের মতো করে,আমাদের পরমাত্মীয় করে,আমাদের বোধে,আমাদের অন্তরে অন্তরে।
রবীন্দ্রনাথ আমাদের কাছে আমাদের৷ জীবনের হাসি কান্নার হীরাপান্না। তাঁর গান,আমাদের জীবনের পরম পাথেয়।
সারাজীবনে তিনি গান সৃষ্টি করেছেন প্রায় দু’ হাজারের ওপর। তার প্রথম গান-” গগনের থালে,/ রবি চন্দ্র দীপক জ্বালে।”
রবীন্দ্রনাথের গানের প্রথম স্বরলিপি প্রকাশিত হয় ১২৯২ বঙ্গাব্দের বৈশাখ মাসে,’বালক’পত্রিকার প্রথম সংখ্যায়। গানটি ছিল-” বল্ গোলাপ মোরে বল্..”। স্বরলিপি করেছিলেন প্রতিভা দেবী। এই সময়ে কবির গান,সুর ইত্যাদি সংরক্ষণের কাজে কবির পাশে থাকতেন দীনেদ্রনাথ ঠাকুর (দীনু ঠাকুর),প্রতিভা দেবী,সরলা দেবী,ইন্দিরা দেবী,অভিজ্ঞা দেবী,অমলা দাশ,প্রমুখ।এঁরা সকলেই কবির সম্পর্কে ভাইঝি,ভাগ্নী,ভাইপো,
ইত্যাদি। কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথ “পিতৃস্মৃতি” গ্রন্থে লিখেছেন -“জোড়াসাঁকোর ছাদের মজলিশে সবাই জড়ো হয়ে চলতো আসর। শুরু হোত গান। পালা করে বাবা,দীনুদাদা,অমলা দিদি,অভিজ্ঞা দিদি,সরলা দিদি,ইন্দিরা দিদি পরপর গান করতেন…।”
রবীন্দ্রনাথের পরিচালনায় “বঙ্গভঙ্গ বিক্ষোভ ” প্রামান্য চিত্র তৈরী হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ বাংলার প্রাচীন লোকসংগীতের সংগ্রাহক ছিলেন,তিনি গগন হরকরা,লালন ফকিরের প্রায় ৩০০ -র বেশি গান সংগ্রহ করেছিলেন।
রবীন্দ্রনাথের প্রথম উপন্যাস ছিল “করুণা” (১৮৭৭-৭৮)। তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ “কবিকাহিনী” (১৮৭৮)।
রবি ঠাকুরের প্রথম গীতিনাট্য -“বাল্মিকী প্রতিভা”(১৮৮১)। প্রথম গদ্যগ্রন্থ-” য়ুরোপ প্রবাসীর পত্র”(১৮৮১)।
প্রথম প্রকাশিত উপন্যাস -” বউ ঠাকুরানীর হাট”(১৮৮৩)।
তাঁর প্রথম প্রবন্ধ গ্রন্থ- “বিবিধ প্রবন্ধ” (১৮৮৩)।
রবীন্দ্রনাথের প্রথম মনস্তাত্ত্বিক উপন্যাস – “চোখের বালি”। প্রথম ছোট গল্প-” ভিখারিনী”।
রবি ঠাকুরের আত্মজীবনী- “জীবন স্মৃতি” এবং “ছেলেবেলা”।
১৯১৩ সালে প্রথম বাঙালি তথা ভারতীয় তথা এশিয়ান হিসাবে রবীন্দ্রনাথ “গীতাঞ্জলী”(Song of Offerings) কাব্যগ্রন্থের জন্য নোবেল পুরষ্কারে ভূষিত হন। পুরষ্কারের টাকা তিনি শান্তিনিকেতনের বিশ্বভারতীর জন্য সাঁকো,সেতু,পয়ঃপ্রণালী তৈরি করতে খরচ করেন,আর বাকি টাকা দিয়ে গ্রামীন কৃষকদের জন্য,তাদের সুবিধার্থে “পাতিসর কৃষি ব্যাঙ্ক” প্রতিষ্ঠা করেন।সেখানে গ্রাম উন্নয়ন এবং গ্রামীন ক্ষুদ্র ঋণ প্রকল্প শুরু হয়।
রবীন্দ্রনাথ হলেন সারাবিশ্বে একমাত্র মানুষ, যিনি তিনটি দেশের জাতীয় সঙ্গীত রচনায় উপস্থিত। ভারতবর্ষের জাতীয় সঙ্গীত- “জনগনমন অধিনায়ক জয় হে..”, বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত-” আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি..”, এবং শ্রীলঙ্কার জাতীয় সঙ্গীত -“মাতা শ্রীলঙ্কা, নম নম নম নম মাতা সুন্দর শ্রী বরনী…”( রবি ঠাকুর-এর গীতবিতানের একটি গানের অনুকরণে রবীন্দ্র স্নেহধন্য এবং শিষ্য আনন্দ সামারাকুল এই গানটির শ্রীলঙ্কান ভাষায় তৈরী করেন)।
রবীন্দ্রনাথ আমাদের কাছে বিভিন্ন শ্রদ্ধেয় আলঙ্কারিক নামে পরিচিত। যেমন “গুরুদেব”- এই নামে শ্রদ্ধা জানান নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু,মহাত্মা গান্ধী,এবং কাজী নজরুল ইসলাম। “বিশ্বকবি” বিশেষনে ভুষিত করেছিলেন ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায় (ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় / স্বামী বিবেকানন্দের সহপাঠী)। “কবিগুরু” নামে শ্রদ্ধা জানিয়েছিলেন প্রথম আচার্য ক্ষিতিমোহন সেন। ১৯২৪ সালে রবীন্দ্রনাথ চীন দেশের আমন্ত্রনে চীনে গিয়েছিলেন।সেই বছর ২৫ শে বৈশাখ (৮ই মে,১৯২৪) কবির জন্মদিন চীনদেশে সরকারী ভাবে পালন করা হয়েছিল,চীনের গভর্নমেন্ট সেখানে কবিকে তাদের দেশের ভাষায় উপাধি বা নাম দিয়েছিলেন- “চু-তেন-তাঙ্”। (জগতের মুখপত্র মহাজ্ঞানী)।
কবি সারাজীবনে অনেক সময়ে নানান ছদ্মনাম ব্যবহার করেছেন,সেগুলি হোল– ” ভানুসিংহ”, “অকপট চন্দ্র ভাস্কর”,
” আন্নাকালী পাকড়াশি”, “দিকশূন্য ভট্টাচার্য”, ” নবীন কিশোর শর্মনঃ”, “ষষ্ঠীচরণ দেবশর্মা”, ” বাণীবিনোদ বিদ্যাবিনোদ “, ” শ্রীমতী প্রথমা”, ” শ্রীমতী দ্বিতীয়া”, ” শ্রীমতী মধ্যমা”, ” শ্রীমতী কণিষ্ঠা”, “ভুতনাথ বাবু”, ” রসিকলাল মিত্র”।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে ডি.লিট. সম্মানে সম্মানিত করে জেনিভা বিশ্ববিদ্যালয়(১৯১৩), কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়(১৯১৩ সাল), এডিনবারা বিশ্ববিদ্যালয়(১৯১৭),হার্বার্ড বিশ্ববিদ্যালয়(১৯২৩), বেজিং বিশ্ববিদ্যালয়(১৯২৪), আর্জেনটিনার বুয়েন্সএয়ার্স বিশ্ববিদ্যালয় (১৯৩২), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়(১৯৩৬), অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় (১৯৪০)।
বৈশাখের আবহাওয়ায় কবিপক্ষের আমন্ত্রন।সমাগত ২৫ শে বৈশাখের চরণধ্বণি। আজ এই এক অস্থিরতায়, অসহিষ্ণুতায়, সমস্যা জর্জরিত সময়ের দিশাহারা পৃথিবীতে, ভারতবর্ষে,বাবাংলা ভাষাভাষি আমাদের কাছে,আমাদের এপার ওপার বাংলায় রবীন্দ্রনাথ আর একবার জন্ম নিক– আমাদের হাত ধরতে,আমাদের পথের পাথেয় হতে,আমাদের অভিভাবক হিসাবে,শুভপথের সন্ধানী আলোকবর্তিকা র মতো,এই হোক আমাদের একান্ত প্রার্থনা।এই অনুরোধে রইল মানবিক আবেদন,রইল শুভবুদ্ধির পরিচয়ের প্রত্যাশা–“অন্ধকারের উৎস হোতে জাগ্রত যে আলো,সেই তো তোমার আলো,/ সকল দ্বন্দ্ব- দ্বিধার মাঝে জাগ্রত যে ভালো, সেই তো তোমার ভালো..।”
সীমাবদ্ধতার কূপমন্ডুকতা থেকে আমরা বেরিয়ে আসি মহাকাশের সীমাহীন প্রান্তরের সীমানায়,উচ্চারণ করি রবীন্দ্রনাথ — “আপন হতে বাহির হয়ে বাইরে দাঁড়া,/বুকের মাঝে বিশ্বলোকের পাবি সাড়া…। “
আমাদের অঙ্গীকার হোক আজ– “ব্যক্ত হোক জীবনেরও জয়,ব্যক্ত হোক তোমা মাঝে অসীমের চির বিস্ময়…। “
জয় হোক মানবিকতার,জয় হোক সম্প্রীতি সহিষ্ণুতার।
জয় হোক মানুষের। জয় হোক শুভ কর্মপথের,আনন্দময় জয়গানের….,সাথে থাকুন আমাদের প্রাণের ঠাকুর, অন্তরের পরশমণি –“রবীন্দ্রনাথ”।