পঙ্কজ চট্টোপাধ্যায়
মহাত্মা গান্ধী, জওহরলাল নেহরুর সঙ্গে হ্যান্ডশেক করেননি। বিধান রায়কে আশীর্বাদও করেননি। বল্লভভাই প্যাটেলের সঙ্গে কথাও বলেননি…। কণ্ঠস্বর ছিল বজ্রকঠিন বলিষ্ঠতায় পূর্ণ। তিনি কি অহংকারী ছিলেন? না, মানুষটি ছিলেন অতি বিনম্র, কিন্তু আপন আদর্শের এক ঋত্বিক। তিনি হলেন বিপ্লবী হেমচন্দ্র ঘোষ।
১৮৮৪ সালের ২৪ অক্টোবর ঢাকার বানারীপাড়ার গাভা গ্রামে হেমচন্দ্র জন্মগ্রহণ করেছিলেন। বাবার নাম ছিল মথুরানাথ ঘোষ।তিনি ছিলেন আইনজীবী। হেমচন্দ্র ঢাকার জুবিলী স্কুলে পড়াশোনা করেন। তিনি শরীরচর্চা এবং কুস্তি শিখেছিলেন শ্যামাকান্ত বন্দ্যোপাধ্যায়-এর(ইনি বাঘের সাথে লড়ে বাঘকে পরাজিত করেন,পরে তিনি সন্ন্যাসী হয়ে যান,তখন তার নাম হয় সোহং স্বামী) কাছে।হেমচন্দ্র লাঠিখেলায় পারদর্শী ছিলেন, তাঁর গুরু ছিলেন বিপ্লবী পুলিনবিহারী দাস।
১৯০০ সালে হেমচন্দ্র কলকাতায় চলে আসেন। বেলুড়মঠে তিনি সাক্ষাৎ করেন এবং সাষ্টাঙ্গপ্রণাম করেন স্বামী বিবেকানন্দকে।হেমচন্দ্র সন্ন্যাসী হতে চেয়েছিলেন, কিন্তু স্বামী বিবেকানন্দ যখন আলাপচারিতায় জানতে পারলেন যে হেমচন্দ্র লাঠিখেলা, কুস্তি, ইত্যাদি শারীরিক কসরত জানেন,তখন স্বামীজি হেমচন্দ্রকে দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের কাজ করতে বলেন। হেমচন্দ্র সেইসময় স্বামী বিবেকানন্দের পরম সান্নিধ্য পেয়েছিলেন অনেকবার।শ্রীমা সারদা,ভগিনী নিবেদিতা প্রমুখের পবিত্র সান্নিধ্যও তিনি পেয়েছিলেন সেই সময়ে। ১৯০১ সালে ফরাসগঞ্জের মোহিনী মোহন দাসের বাড়িতে স্বামী বিবেকানন্দ-এর সঙ্গী হিসাবে ১৫-১৬ দিন একসঙ্গে হেমচন্দ্র ছিলেন। সেখানেও স্বামীজি হেমচন্দ্রকে দেশের কাজে আত্মনিয়োগ করতে উপদেশ দেন।
সেই উপদেশ শিরোধার্য করে হেমচন্দ্র ১৯০১ সালে বিপ্লবী উল্লাসকর দত্তের সাহায্যে শ্রীঅরবিন্দের ছোটভাই বিপ্লবী বারীন্দ্রনাথ ঘোষের সঙ্গে পরিচয় করেন এবং অনুশীলন সমিতি ও যুগান্তর গোষ্ঠীর বিপ্লবী কার্যকলাপের প্রতি আকৃষ্ট হন।
১৯০৫ সালে শ্রীশ পাল, হরিদাস দত্ত, গুণেন্দ্রনাথ ঘোষ, রাজেন গুহ, মাখন চক্রবর্তী, খগেন দাস, নিকুঞ্জ সেন, বিভুতি বসু, সুরেন বর্ধন, প্রমুখদের নিয়ে “মুক্তি সংঘ” নামে একটি সংগঠন গঠন করেন হেমচন্দ্র ঘোষ। সেখানে হেমচন্দ্র ঘোষ ছিলেন বড়দা, আর হরিদাস দত্ত ছিলেন মেজদা।
১৯০৬ সালে হেমচন্দ্র ঘোষ ঘনিষ্ঠ সম্পর্কযুক্ত হন যাঁদের সাথে,তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন,শ্রী অরবিন্দ, ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায়,বিপিনচন্দ্র পাল,প্রমুখ বিপ্লবীগণ।
১৯০৮ সালের শেষে হেমচন্দ্র ব্রিটিশ সরকারের পুলিশ অফিসার নন্দলাল ব্যানার্জি (যে বিপ্লবী ক্ষুদিরামের গ্রেপ্তার এবং ফাঁসীর জন্য সম্পুর্ন দায়ী)-কে হত্যা করেন।
১৯১৪ সালে রডা কোম্পানির অস্ত্রলুন্ঠন-এর সাথেও হেমচন্দ্র যুক্ত ছিলেন। এরপর তিনি ধরা পড়েন ব্রিটিশ পুলিশের হাতে।বিচারে কারাদণ্ড হয় এবং প্রায় ৬ বছর হেমচন্দ্র হাজারিবাগ জেলেতে বন্দী ছিলেন। ১৯২০ সালে জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার পরে হেমচন্দ্র কলকাতায় চলে আসেন এবং গোপনে আবার বিপ্লবী কাজে যুক্ত হয়ে পড়েন। ১৯২৬ সালে
মুক্তি সংঘের সদস্যরা “বেনু” নামে একটি মাসিক পত্রিকা প্রকাশ করেন। হেমচন্দ্র ছিলেন সেই পত্রিকার সম্পাদক।সেই সময়ে তার নাম ছিল রাখাল চন্দ্র ঘোষ।
এরপর তিনি বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স নামে একটি বিপ্লবী গুপ্ত সংগঠন তৈরী করেছিলেন। যার সাথে যুক্ত ছিলেন স্বয়ং নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু। নেতাজী হেমচন্দ্র ঘোষকে অগ্রজের আসনে বসিয়েছিলেন। তাঁর কাছ থেকেই সুভাষচন্দ্র অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষিত হন। কথিত আছে,যে,হেমচন্দ্র ঘোষ যে হাত দিয়ে স্বামী বিবেকানন্দ-এর পবিত্র চরণপদ্ম স্পর্শ করে প্রনাম করেছিলেন, সেই হাত দিয়ে তিনি একমাত্র সুভাষ চন্দ্র বসুকেই আশীর্বাদ করেছিলেন, তাছাড়া আর কারও সাথে সেই হাত মেলাননি,আশীর্বাদও করেননি,প্রনাম তো করেনই নি কোনোদিন। এই প্রসঙ্গে বলা যায় তিনি মহাত্মা গান্ধী, জওহরলাল নেহরু,প্রমুখদের সাথে দুরত্ব বজায় রেখেই কথা বলতেন।এদের নেতা বলে তিনি স্বীকারই করতেন না।হেমচন্দ্র বলতেন,যে হাত স্বামী বিবেকানন্দের পবিত্র পাদস্পর্শ করেছে,সেই হাতে হাত রাখার কোনো যোগ্যতাই ওনাদের নেই।
ভারতবর্ষের অগ্নিযুগের বিপ্লবের অন্যতম নেতা ছিলেন হেমচন্দ্র ঘোষ। পাঞ্জাবের ভগৎ সিং,চন্দ্রশেখর আজাদ,শুকদেব,রামপ্রসাদ বিসমিল,প্রমুখদের বৈপ্লবিক কাজের রূপকার ছিলেন তিনি।রাসবিহারী বসুর বৈপ্লবিক কাজেরও রূপকার ছিলেন তিনি।
হেমচন্দ্র ছিলেন মেদিনীপুর জেলার তিনজন উচ্চপদস্থ ব্রিটিশ পুলিশ অফিসার, কুমিল্লার অত্যাচারী ম্যাজিস্ট্রেট-কে খতম করার প্রধান নায়ক।এই সময়ে হেমচন্দ্র ঘোষের সাথে ছিলেন বিপ্লবী সত্যরঞ্জন বক্সী।
ঐতিহাসিক বিনয় বসু, বাদল গুপ্ত, দীনেশ গুপ্তের রাইটার্স বিল্ডিং অভিযানের রূপকার ছিলেন হেমচন্দ্র ঘোষ।
এখানে উল্লেখ্য যে,১৯৩০ সাল থেকে ১৯৪৭ সাল এই ১৬/১৭ বছরের সময়কালে হেমচন্দ্র ঘোষ মাত্র দেড় বছর জেলের বাইরে ছিলেন।
প্রসঙ্গক্রমে বলা যায় বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একটি গানে লিখেছিলেন, “মধ্যদিনে যবে গান বন্ধ করে পাখি, হে রাখাল বেনু তব বাজাও একাকী..”(এখানে উল্লেখ্য যে ১৯২৬ সালে ব্রিটিশ সরকার যখন মুক্তি সংঘের, অনুশীলন সমিতি, যুগান্তর গোষ্ঠীর বিপ্লবীদের বন্দী করে জেলে পাঠায়,তখন একা গোপনে হেমচন্দ্র ঘোষ “বেনু” পত্রিকার দায়িত্ব নেন,এবং অতি গোপনীয়তায় সেই কাজে নিজেকে নিয়োজিত করেছিলেন)।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে হেমচন্দ্র ঘৃনা করতেন দেশের নেতাদের(সুভাষচন্দ্র ব্যাতিত)। কারন তিনি দেশভাগের চরম বিরোধী ছিলেন। তাই দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে হেমচন্দ্র যখন জেলের বাইরে এলেন,কলকাতার দক্ষিনে থাকতে শুরু করলেন,তখন দেশের সরকার প্রদত্ত যাবতীয় সম্মান ও স্বীকৃতি তিনি অত্যন্ত ঘৃনায় প্রত্যাখ্যান করেছিলেন।
তিনি আমরণ একাই থাকতেন।১৯৮০ সালের ৩১ শে অক্টোবর বিপ্লবী হেমচন্দ্র ঘোষ সবার অলক্ষ্যে চিরবিদায় নিয়ে ইতিহাস হয়ে যান।
এমন এক সর্বত্যাগী অগ্নিস্নাত বিপ্লবীকে এই বাংলা,এই ভারতবর্ষ স্মরণ করার কথাই ভুলে গেছে বহুদিন আগে। যা আমাদের দেশের অমার্জনীয় অপরাধ এবং অমার্জিত লজ্জা।
এই মহান ঐতিহাসিক ব্যক্তির প্রতি রইল আমাদের সকলের প্রণাম।