পঙ্কজ চট্টোপাধ্যায়
মানুষের জীবনের সাথে সামাজিকভাবে তিনটি সম্পর্ক অবশ্যই থাকে। আর তা হোল মা,বাবা আর মাস্টার মশাই বা দিদিমনি।
স্বামী বিবেকানন্দের কথায় “এসো মানুষ হও,আর।মানুষ হতে গেলে ওসব দেব-দেবী ভজনা না করে মা-বাবা আর শিক্ষার্থী হয়ে সেই মানুষগুলোর পায়ের কাছে মাথা ঠেকিয়ে বোস..যারা আমাদের মনে-ভাবনার মধ্যে যে অজ্ঞানতার অন্ধকার রয়েছে,তাকে জ্ঞানের আলোর জগতে নিয়ে আসবে। শিক্ষা,শিক্ষা,শিক্ষাই হোল একমাত্র পথ,যা আমাদের কূপমন্ডুকতাকে ঘোচাবে। “(প্রাচ্য-পাশ্চাত্য)
আজ শিক্ষক দিবসের এই সম্মানিত দিনে মনে পড়ে আলবার্ট আইনস্টাইনের সেই কথা :”সৃষ্টিশীলতাকে প্রকাশ করা এবং জ্ঞানের মধ্যে আনন্দকে জাগ্রত করা এই দুই-ই আমরা পেতে পারি শিক্ষকদের কাছে,তাই বাবা-মা আর শিক্ষকদের নিয়ে মানুষের জীবনের ভিত্তি স্থাপিত হয়”।
আমাদের দেশের বিজ্ঞানী এবং রাষ্ট্রপতি ডঃ আবুল পাকির জয়নুলাবেদিন আব্দুল কালাম (এপিজে আব্দুল কালাম) এই শিক্ষক দিবসেই শিক্ষদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে ২০০৩ সালে তাঁর ভাষনে বলেছিলেনঃ..”তিনজনই পারেন একটি দেশ বা জাতিকে বদলাতে।তাঁরা হলেন বাবা-মা এবং শিক্ষক।”
আজ এই শিক্ষক দিবসের উদযাপনে প্রসঙ্গত এসে পড়ে আমাদের দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার প্রনালীকে নিয়ে রবীন্দ্রনাথের মহাবানীগুলি,যা বোধহয় আজও প্রাসঙ্গিক:
” বিদ্যা যে দেবে এবং বিদ্যা যে নেবে তাদের উভয়ের মাঝখানে যে সেতু, সেই সেতুটি হচ্ছে ভক্তি-স্নেহের সম্মন্ধ। সেই আত্নীয়তার সম্মন্ধ না থেকে যদি কেবল শুষ্ক কর্তব্য বা ব্যবসায়ের সম্মন্ধই থাকে, তা হলে যারা বিদ্যা পায় তারা হতভাগ্য,আর যারা তা দেয় তারাও হতভাগ্য”। (শিক্ষা ও শিক্ষা-সমস্যা)
সত্যিই তো শিক্ষার প্রাঙ্গনে আন্তরকিতা অবশ্যই দরকার। তা না হলে শিক্ষার যে মূল কারণ বা উদ্দেশ্য সেই জিনিষটিই আমাদের শিক্ষার্থী জীবনে আমরা খুঁজেই পাব না। মাস্টার মশাই দিদিমনিদের সাথে সম্পর্ক হবে অতি আপনজনের মতো।কিন্তু বাস্তবে তা যেন সব সময়ে সবখানে দেখতে পাওয়া যায় না। আর,এর ফলেই শিক্ষার মূল ভিত্তি যে আন্তরিকতা তা সেখানে জন্ম নেয় না,জন্ম নেয় এক নিছক উভয়পক্ষের দায়সারা যান্ত্রিকতা। রবীন্দ্রনাথের কথাতেই দেখা যাকঃ..” আমাদের শিক্ষার মধ্যে এমন একটি সম্পদ থাকা চাই, যা কেবল আমাদের তথ্য দেবে না,সত্য-ও দেবে; যা কেবল ইন্ধন দেয় না,অগ্নি-ও দেয়।” বিশ্বভারতীর এক অনুষ্টানের উদ্বোধনে তিনি উপরের কথাগুলির সাথে আরও বলেনঃ..”শিক্ষকের দ্বারাই শিক্ষা-বিধান হয়,প্রনালীর দ্বারা হয় না।”( বিশ্বভারতী /রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)।
শিক্ষক দিবসের প্রাসঙ্গিকতা আমাদের দেশ সহ সারা বিশ্বে আজ সমাদৃত। আমাদের দেশে প্রতি বছর ৫ই সেপ্টেম্বর দিনটি শ্রদ্ধায়,বিনম্রতায় পালিত হয় শিক্ষক দিবস হিসাবে। প্রসঙ্গ ক্রমে, এই দিনটি হোল ভারতবর্ষের প্রথম উপ-রাষ্ট্রপতি এবং দ্বিতীয় রাষ্ট্রপতি ডঃ সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণান-এর জন্মদিন।
ডঃ রাধাকৃষ্ণান ১৮৮৮ সালের ৫ই সেপ্টেম্বর দক্ষিন ভারতের তামিলনাড়ু(আগের মাদ্রাজ)-র তিরুত্তানি-তে একটি দরিদ্র পরিবারে। বাবার নাম ছিল সর্বপল্লী বীরাস্বামী এবং মায়ের নাম ছিল শ্রীমতী সীতাম্মা দেবী।
ছাত্রজীবনে তিনি অত্যন্ত মেধাবী ছিলেন। জীবনের কোন পরীক্ষাতেই তিনি দ্বিতীয় হন নি। তিনি মাদ্রাজ খ্রিস্টান কলেজ থেকে দর্শন শাস্ত্রে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী লাভ করেন(১৯০৪-১৯০৮)।
তিনি এতই গরীব ঘরের মানুষ ছিলেন যে তিনি পড়ার বই অন্যের কাছ থেকে চেয়ে নিয়ে পড়াশোনা করতেন। তাঁর গবেষনা মূলক লেখা প্রবন্ধ “বেদান্ত দর্শনর বিমূর্ত পূর্বকল্পনা”(The Ethics of the Vedanta and its Metaphysical Presupposition) ।
তিনি ভেবেছিলেন এই লেখা হয়তো তাঁর Professor বাতিল করে দেবেন।কিন্তু, সেই লেখা পড়ে অধ্যাপক ডঃ আলফ্রড্ জর্জ্ হগ্ এতোই খুশী হয়েছিলেন যে,সেই প্রবন্ধখানি ছাপানো হয় পুস্তক হিসাবে।তখন রাধাকৃষ্ণানের বয়স মাত্র ২০ বছর।
তাঁর বাবা চেয়েছিলেন ছেলে পুজারী হোক।কিন্তু ছেলের জেদের কাছে হার স্বীকার করে তাকে তিরুপতির একটি স্কুলে ভর্তি করেন বাবা।স্কলারশিপ নিয়েই তিনি পড়াশোনা করেন।প্রথমে ভেল্লোরের ভুরহি কলেজে এবং তারপরে মাদ্রাজ খ্রিস্টান কলেজে পড়েন তিনি।
১৯০৮ সালেই মাদ্রাজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর পাশ করে তিনি মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সী কলেজে অধ্যাপনা শুরু করেন। পরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়,মহিশুর বিশ্ববিদ্যালয়,অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়-তে অধ্যাপনা করেন।পরে তিনি অন্ধ্র বিশ্ববিদ্যালয় এবং বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়-তে উপাচার্যের ভুমিকাও পালন করেন তিনি।
তিনি ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে অসম্ভব জনপ্রিয় ছিলেন।কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যেদিন তিনি মহিশুর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসাবে দায়িত্ব নিয়ে চলে যাচ্ছেন,সেদিন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়-এর ছাত্র-ছাত্রী,আর অন্যান্য অধ্যাপক-বৃন্দ ডঃ রাধাকৃষ্ণান-কে ফুল দিয়ে সাজানো গাড়িয়ে করে কলেজ স্ট্রিটের বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাঙ্গন থেকে হাওড়া রেল-স্টেশন অবধি নিয়ে গিয়ে তাঁকে ট্রেনের বিশেষ কামরাতে তুলে দেন।সে এক অভূতপূর্ব দৃশ্য।
প্রথম জীবনে মাইসোর বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকার সময়ে (১৯১৮) তিনি বিভিন্ন উল্লেখযোগ্য পত্রিকায় লিখতেন। সেই সময়েই তিনি লেখেন তাঁর প্রথম গ্রন্থ “The philosophy of Rabindranath. Tagore “। দ্বিতীয় গ্রন্থ..” The Reign of Religion in Contemporary Philosophy. (১৯২০) তে প্রকাশিত হয়।
তাঁর বয়স যখন ১৬,তখন তিনি বিয়ে করেন,স্ত্রীর নাম ছিল শ্রীমতী শিবাকামু। স্ত্রী ১৯৫৬ সালে মারা যান।
সারা বিশ্বের দরবারে তিনি অতি জনপ্রিয়,সম্মানীয় দার্শনিক অধ্যাপক হিসাবে সমাদৃত ছিলেন।১৯৩১ সালে তাঁকে “British Knight-Hood ” সম্মানে সম্মানিত করা হয়। ১৯৫৪ সালে তিনি “ভারতরত্ন” উপাধিতেও ভূষিত হন।
১৯৬৩ সালে তিনি “British Order of Merit” সম্মানে সম্মানিত হন।
তিনি বিশ্বভারতী,দিল্লী বিশ্ববিদ্যালয়, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়,মাদ্রাজ বিশ্ববিদ্যালয়,বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়, প্রমুখের আচার্য পদে সম্মানিত হন। তিনি ইউনেস্কোর এক্সিকিউটিভ বোর্ডের চেয়ারম্যান ছিলেন।
তিনি ১৯৩১ সালে নাইট উপাধি পেলেও কখনোই “স্যার” শব্দটি ব্যবহার করতেন না।সেই স্থানে ব্যবহার করতেন “Professor (DR.)” শব্দ।
১৯৩৮ সালে তিনি ব্রিটিশ একাডেমির “ফেলো” নির্বাচিত হন।
১৯৫৪ সালে জার্মান সরকারের সর্বোচ্চ সম্মান “Order Pour Le Merit for Arts and Science” সম্মানে ভুষিত হন।
১৯৬২ সালে তিনি “The Peace Prize of The German Book Trade” সম্মানে সমাদৃত হন।
১৯৬৮ সালে তিনিই ছিলেন প্রথম ব্যক্তি,যিনি একজন লেখক হিসাবে “সাহিত্য একাডেমি ফেলোশিপ” পান সাহিত্য একাডেমির পক্ষ থেকে।
১৯৭৫ সালে তিনি অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি দ্বারা “Templeton Prize” এর সম্মানে সম্মানিত হন।
তিনি অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি সহ সারা বিশ্বের বিশ্ব বিদ্যালয়গুলিতে তাঁর সাধ্য মতো অনুদান দিয়ে গেছেন তাঁর উপার্জন থেকে,এটা একটি বিরাট উদাহরন সারা বিশ্বে। তাই তাঁর মৃত্যুর পরে ১৯৮৯ সালে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি তাঁর নামে স্কলারশিপ প্রবর্তন করেন..যার নাম “Doctor Servepally Radhakrishnan Cheventing Scholarship”.
অধ্যাপক শিক্ষক তথা বিশ্ব-বন্দিত দার্শনিক ডঃ সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণান ১৯৪৬ সালে ইউনেস্কোতে ভারতের রাষ্ট্রদুত হয়েছিলেন এবং ১৯৪৯ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নে ভারতবর্ষের রাষ্ট্রদূত হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। তিনি কোনদিনই কোন রাজনৈতিক দলের সদস্য ছিলেন না। তিনি ছিলেন ভারতীয় ঐতিহ্যের এবং সংস্কৃতির এক মূর্ত প্রতীক। আমাদের দেশের স্বাধীনতার পরে ১৯৫২ সালে প্রথম রাষ্ট্রপতি হন ডঃ রাজেন্দ্র প্রসাদ,আর উপ-রাষ্ট্রপতি হন ডঃ সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণান।
১৯৬২ সালে তিনি ভারতবর্ষের রাষ্ট্রপতি হন,একটানা ১০ বছর উপরাষ্ট্রপতি পদে আসীন থাকার পরে।
নোবেলজয়ী ব্রিটিশ দার্শনিক বারট্রান্ড্ রাসেল্ বলেছিলেনঃ..” ডঃ রাধাকৃষ্ণান ভারতবর্ষের রাষ্ট্রপতি হওয়া মানে দর্শন বিষয়টির কাছে একটি আলাদা সম্মানের। আমি নিজে দার্শনিক,তাই আমি অত্যন্ত গর্বিত ।”
১৯৬২ সালে ডঃ রাধাকৃষ্ণান আমাদের দেশের রাষ্ট্রপতি হওয়ার পরে দেশে-বিদেশের তাঁর ছাত্র-ছাত্রীরা,গুণমুগ্ধ গন সকলেই তাঁর জন্মদিন ৫ ই সেপ্টেম্বর-কে বিশেষভাবে উদযাপন করতে চেয়েছিলেন। ডঃ রাধাকৃষ্ণান সেই পরিপ্রেক্ষিতে সেদিন বলেছিলেনঃ..” জন্মদিন উদযাপন না করে সেই দিনটি যদি শিক্ষক দিবস হিসাবে পালন করা হয়, তাহলে আমি কৃতজ্ঞ থাকব..”। সেই থেকেই আমাদের দেশে ৫ ই সেপ্টেম্বর শিক্ষকদের, শিক্ষিকাদের সম্মান জানাতে শিক্ষক দিবস হিসাবে পালন করা হয়।
১৯৭৫ সালের ১৭ ই এপ্রিল চেন্নাইতে ডঃ রাধাকৃষ্ণান আমাদের থেকে চির বিদায় নিয়ে অমর্ত্যলোকে যাত্রা করেন।
১৯৯৫ সালে UNESCO (Educational International Authority) সারা বিশ্বে শিক্ষক দিবস হিসাবে পালন করে।
আজ পবিত্র শিক্ষক দিবসে তাই বলা ভালো যে, ” A great teacher is like a candle…it consumes itself to light the way to others.”
শিক্ষক-শিক্ষিকারা হলেন মানব সমাজের আলোক বর্তিকা, জ্ঞানের আলোয় আলোকিত করে চলেন প্রজন্মের পর প্রজন্মের মানব জাতিকে। আজ এই দিনে তাঁদের পদপ্রান্তে রেখে যাই বিনম্রতায় শ্রদ্ধা,শুভেচ্ছা,অভিনন্দন এবং ভালোবাসা।