শুভেন্দুর উগ্র স্বরে ‘হিন্দু-মুসলমান’ কি ২০২৬-এর লক্ষেই?

২০২১ বিধানসভা, ২০২৪ লোকসভা এবং বেশকিছু কেন্দ্রের উপনির্বাচনের ফল বলছে, ক্ষয় রোগে আক্রান্ত বঙ্গ বিজেপি। এমন পরিস্থিতিতে উগ্র হিন্দুত্বের দাওয়াই-ই একমাত্র উপশম। লিখলেন ইমনকল্যাণ সেন

একের পর এক ভোটে রাজ্য বিজেপির ভরাডুবি নিয়ে দলের অন্দরে দায় ঠেলাঠেলি নতুন নয়। সেই আবহে দলীয় বৈঠকে যোগ দিয়ে নতুন এক বিতর্ক উসকে দিয়েছেন বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী। কড়া হিন্দুত্বের কথা বলে দলের একাংশের সমালোচিত হচ্ছেন। বিতর্কে জড়িয়ে নিজের ব্যক্তব্যের ব্যাখ্যাও দিয়েছেন বিরোধী দলনেতা। তবে আপাত দৃষ্টিতে এটাকে নিছক এক তাৎক্ষণিক বিতর্ক ভেবে নিয়ে উপসংহারে পৌঁছনো সহজ হলেও বাস্তবে এর শিকড় অনেক গভীরে।

সংক্ষেপে শুভেন্দুর বক্তব্য

বুধবার সায়েন্স সিটি অডিটোরিয়ামে পশ্চিমবঙ্গ বিজেপির বর্ধিত প্রদেশ কার্যকারিণী বৈঠক হয়। সেখানে বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী বক্তব্য রাখতে গিয়ে বলেন, ‘‘আমিও বলেছি রাষ্ট্রবাদী মুসলিম। আপনারাও বলেছেন সবকা সাথ সবকা বিকাশ। আর বলব না। বলব, যো হামারি সাথ, হাম উনকা সাথ। সব কা সাথ, সব কা বিকাশ বন্ধ করো।’’ পাশাপাশি তিনি স্পষ্ট করে দিয়েছেন, সংখ্যালঘু মোর্চা চাই না। বক্তৃতার একেবারে শেষে বলেন, ‘‘নো নিড ফর সংখ্যালঘু মোর্চা।’’ রাজ্যের উপদ্রুত এলাকা আইন লাগু করে ভোট করানোর দাবিও তুলেছেন।

এখানেই শেষ নয়, হিন্দু ভোটারদের কাছে টানতে শুভেন্দু আরও বলেন, “এই যে আমার হাতে কালি দেখছেন, আমি আজ বলছি, ২০২৬ সালে আমাকেও ভোট দিতে দেবে না। কারণ আমি হিন্দু। আমার বাড়ির সামনে সকাল থেকে ৫০ জন জিহাদি বসে থাকবে। দর্শকের আসন গ্রহণ করবে পুলিশ। এখনই যদি না জাগি আমরা, সায়েন্স সিটিতে বসে রয়েছি, ১০ কিলোমিটার দূরে ঘটকপুকুর, ভাঙড়। চারটি হিন্দু অঞ্চল আছে, আমি এবারে ড্রাই জোনে ঘুরেছিলাম, বাদুড়িয়া, হাড়োয়া, ভাঙড়, ক্যানিং পশ্চিম…যেখানে ওরা ১.৫০২ লক্ষ ভোটে জেতে। কী হয় দেখতে গিয়েছিলাম। চারটি হিন্দু অঞ্চল রয়েছে ভাঙড়ে। দু’টো অঞ্চলের কোনও হিন্দুকে ভোট দিতে দেয়নি সওকত মোল্লা।” ভাঙড় ইসলামাবাদ হয়ে গিয়েছে বলেও দাবি করেন শুভেন্দু।

সমর্থন আসছে ধীরে ধীরে

শুভেন্দুর এমনই সব মন্তব্য ঘিরে জলঘোলা হওয়াটাই স্বাভাবিক। বিজেপি রাজ্য নেতৃত্বের অনেকেই সরাসরি সমালোচনা করেছেন, কেউ আবার দায় ঝেড়ে ফেলেছেন। তবে ধীরে হলেও সমর্থন আসছে।

এমন পরিস্থিতিতে শুভেন্দুর পাশে দাঁড়িয়েছেন বঙ্গ বিজেপির প্রাক্তন রাজ্য সভাপতি তথাগত রায়। তিনি এক্স হ্যান্ডেলে (আগের টুইটার) লিখেছেন, “রাজনীতিতে সকলের সাহস থাকে না এতটা সত্যি এতটা জোরে বলার। শুভেন্দু অধিকারী দীর্ঘজীবী হোন।” পরে তিনি আরও লেখেন, “মঞ্চে শুভেন্দু যা বলেছেন, তা ধ্রুব সত্য। বাকিটা রাজনীতি।” এ প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে তিনি ফিরহাদ হাকিম, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রসঙ্গও টেনে আনেন। তবে এটা যে হওয়ার তা ঘটনার দিনই স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল। নিজের বক্তব্য নিয়ে জলঘোলা হতেই ব্যাখ্যাও দিয়েছিলেন শুভেন্দু। আর সেটা প্রচার করা হয় দলেরই সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মে। এই সমর্থনের বহর ক্রমশ দীর্ঘায়িত হতে পারে। রাজ্য রাজনীতিতে বঙ্গ বিজেপির বর্তমান অবস্থান এবং দলের ভবিষ্যত সে কথাই জানান দিচ্ছে।

অমিত শাহের অনুমোদন?

দিন সাতেক আগে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের বাসভবনে বৈঠক করেন শুভেন্দু অধিকারী। লোকসভা নির্বাচনে বাংলায় ধরাশায়ী হওয়ার পর বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের পক্ষ থেকে তেমন কেউ বাংলায় আসেননি। সেখানে এতদিন পর নিজে গিয়ে অমিত শাহের সঙ্গে বৈঠক করে রাজ্যের বিশদ তথ্য তুলে ধরেন শুভেন্দু। জানা যায়, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে একটি পেনড্রাইভ দেন শুভেন্দু। সেখানে বেশ কয়েকটি ভিডিয়ো আছে গণপিটুনির এবং হিংসার।

ওই বৈঠকের পর শুভেন্দু নিজেই জানিয়েছিলেন, “অমিত শাহজি মন দিয়ে শুনেছেন এবং কেন্দ্রের পক্ষ থেকে সম্পূর্ণ সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছেন।’’ বাকিটা ক্রমশ প্রকাশ্যে আসছে। ২০২১ বিধানসভা, ২০২৪ লোকসভা এবং বেশকিছু কেন্দ্রের উপনির্বাচনের ফল বলছে, ক্ষয় রোগে আক্রান্ত বঙ্গ বিজেপি। এমন পরিস্থিতিতে উগ্র হিন্দুত্বের দাওয়াই-ই একমাত্র উপশম। যেখানে তৃণমূল ছাড়াও অন্য বিরোধী দলগুলির দাবি, কেন্দ্রীয় এজেন্সি দিয়ে ভোটে জেতা যায় না।

শুভেন্দুর ঘনিষ্ঠ সূত্র উদ্ধৃত করে মিডিয়া রিপোর্টে উল্লেখ্য করা হয়েছে, অমিত শাহর ছাড়পত্র নিয়েই সায়েন্স সিটি অডিটোরিয়ামে সভায় উগ্র স্বরে হিন্দু-মুসলমান করেছেন শুভেন্দু। নইলে লোকসভা ভোটে বিজেপির হয়ে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক নির্বাচনী প্রচার সভা করা বিরোধী দলনেতা এতটাই অনভিজ্ঞ নন যে তিনি দলের উচ্চ পর্যায়ের বৈঠকে এমন সব মন্তব্য বেমালুম করে ফেলবেন। কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের সায় না থাকলে শুভেন্দু অধিকারীর মতো পোড়খাওয়া নেতার পক্ষে এ ধরনের মন্তব্য করা ধারণার বাইরে।

তবে ঠিক যে উদ্দেশ্য এবং কৌশল নিয়ে ২০২৬ – এর লক্ষে এগোতে চাইছে শুভেন্দু – নির্ভর বিজেপি, সেটা পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক আবহাওয়ায় কতটা মানিয়ে নিতে পারবে, অদূর ভবিষ্যতে সেটাই দেখার!

Related posts

‘মহিষাসুরমর্দিনী’- কিছু অজানা কথা

‘ইন্ডিয়া দ্যাট ইজ ভারত’, কিছু ঐতিহাসিক তথ্য

তিনিই ছিলেন একমাত্র “ঐক্যপুরুষ”