পঙ্কজ চট্টোপাধ্যায়
প্রথম জীবনে গুজরাটের বরোদাতে থাকাকালীন শ্রী অরবিন্দের জীবন ধীরে ধীরে অতি সাধারণ জীবনের অভ্যাসে স্বয়ং অরবিন্দ অভ্যস্ত করেন।
পরে কলকাতায় মানিকতলা বোমা মামলায় অভিযুক্ত হয়ে আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে ব্রিটিশ দ্বারা গ্রেফতার হয়ে ছিলেন।জেলের ভিতর থাকাকালীন তিনি জল ছাড়া কিছু তুলসি পাতা চিবিয়ে খেতেন। সেই কারণেই অনেকদিন তিনি অনাহারে কাটিয়েছেন।
এরপর যখন তিনি শ্রীমা সারদামনি-কে প্রণাম করে, হুগলির চন্দননগর হয়ে চলে গেলেন পুদুচেরী (পণ্ডিচেরি)- তে,তখনও প্রথমদিকে তিনি বেশ কয়েকদিন অনাহারে থেকেছেন।
তারপর অরবিন্দ পুদুচেরী-তে এক তামিল ব্রাহ্মণ শঙ্কর ছেত্রীর বাড়িতে আত্মগোপন করেছিলেন বহুদিন। শঙ্কর ছেত্রীর পরিবার ছিল নিরামিষাশী। সেখানে অরবিন্দ ছাড়াও তাঁর অনেক সহযোগী স্বদেশী বিপ্লবীরা তাঁর সাথে আত্নগোপন অবস্থায় থাকতেন।
এইখানেই একটি মজার ঘটনা ঘটেছিল। যেহেতু শঙ্কর ছেত্রীর বাড়ির সকলে নিরামিষাশী ছিলেন,তাই আমিষ খাওয়ায় অভ্যস্ত অরবিন্দ এবং তাঁর সহযোগীরা লুকিয়ে লুকিয়ে রোজ ডিম সেদ্ধ খেতেন।আর ডিমের খোসাগুলি ঘরের জানলা দিয়ে ফেল্ব দিতেন। তাঁরা ভাবতেন সেগুলি রাস্তায় গিয়ে পড়ছে,কিন্তু না…,রাস্তায় না পড়ে, সেগুলি আদপে শঙ্কর ছেত্রীর বাড়ির উঠোনে গিয়ে পড়তো। শঙ্কর ছেত্রীর পরিবারের লোকেরা বিষয়টি বুঝতে পেরেও কিছুই বলতেন না।পরে শ্রী অরবিন্দ জানতে পারেন,এবং আমিষ খাওয়া বন্ধ করে দেন। আজও সেই বাড়িটি আছে।পণ্ডিচেরীতে গেলে শ্রী অরবিন্দের আশ্রম অরোভিলের একটু দুরেই সকলেই সেই বাড়িটি দেখতে যান।
অরবিন্দ লুচি,রুটি,পরোটা খেতে খুব ভালোবাসতেন। তিনি পোস্ত, বেগুনের তরকারি, বিউলি ডাল, মুগের ডাল, খিচুড়ি, টকের ডাল, আলুভাজি, আলুচচ্চড়ি, পটলের দোরমা, ইত্যাদি খেতে খুব ভালোবাসতেন।
শ্রী অরবিন্দের অভ্যাস ছিল ভোরে উঠে “ওরিয়েন্টাল বাম” দিয়ে মাড়ি মাজতেন।তিনি ব্রাশ ব্যবহার করতেন না।হাত দিয়ে,নিমের মাজন ব্যবহার করতেন। সারাদিনে তিনি তিনবার খেতেন।সকালে,দুপুরে আর রাত্রে।
তিনি যখন বিলাতে ছিলেন তখন তিনি ভীষণ চা খেতেন,চুরুট, সিগারেট খেতেন। পরে ছেড়ে দিয়েছিলেন। তিনি খাওয়ার পরে প্রতিবার স্নান করতেন।শীত গ্রীষ্ম, বারোমাস তিনি শেষ স্নান করতেন মধ্যরাত্রে।
সকালে ৯/৯.৩০ টার সময়ে খেতেন,দুপুরে প্রায় ৩টের সময়,আর রাত্রে ৯টা থেকে ১০টার মধ্যে তিনি খেতেন।
শ্রী অরবিন্দের পছন্দের তালিকাতে সব ধরনের সবজি,ফল, মিষ্টি,দই ছিল খাবারের তালিকায়। তিনি স্বল্পাহারী ছিলেন। এক সময়ে তেল মশলার রান্না খাবার তিনি খুব বেশী খেতেন।কিন্তু যখন ১৯৪৭ সালে অসুস্থ হলেন,তখন থেকে তিনি সেই খাবার অনেক কমিয়ে দিলেন।
শ্রী অরবিন্দের খাবারের বিষয় টি তদারক করতেন আশ্রমের শ্রীমা। আর শ্রী অরবিন্দের জন্য লুচি ভেজে দিতেন মৃদুলা দেবী নামের এক আশ্রমিক সাধিকা। বাকী রান্নার ভার ন্যস্ত ছিল অমিয়া,নলিনী নামের দুই আশ্রমিক সাধিকার ওপরে।
শ্রী অরবিন্দের খাবারের সময়ে সেই ঘর খুব পবিত্রভাবে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে,সেখানে ধুপ জ্বালিয়ে দেওয়া হতো। তারপর সেই ঘরে ঋষি একা প্রথমে ধ্যান করতেন,তারপর থালা থেকে অল্প অল্প খাবার চামচ দিয়ে তুলে আলগোছে মুখের মধ্যে দিতেন।কখনোই খাবার উচ্ছিষ্ট করতেন না। তারপর খাবারের অবশিষ্টাংশ বাগানে গাছের গোড়ায় রেখে আসা হতো। পাখীরা এসে সেসব খেয়ে যেত।
শ্রীঅরবিন্দ প্রথম জীবনে ছিলেন একজন আই.সি.এস.,তিনি শাসক ব্রিটিশ-এর গোলামি করতে চান নি। চাকরি ত্যাগ করে ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। পরে ব্রিটিশ সরকার তাঁকে গ্রেপ্তার করে আলিপুর সেণ্ট্রাল জেলে কারারুদ্ধ করে রাখে। এরপর বিচার হয়।সেই বিচারের প্রধান বিচারক ছিলেন শ্রী অরবিন্দের সহপাঠী ( তখনকার দিনে আই.সি.এস.পরীক্ষা, পড়াশোনা হতো লন্ডনে। আই.সি.এস.পরীক্ষায় শ্রী অরবিন্দ হয়েছিলেন প্রথম,আর এই প্রধান বিচারক হামফ্রে ফ্রেড হয়েছিলেন দ্বিতীয়)।
যাইহোক, সেই বিচার চলাকালীন অরবিন্দের পক্ষে আইনজীবী ছিলেন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ। সেই বিচার চলাকালীন অরবিন্দের মধ্যে এক ঐতিহাসিক অতিপ্রাকৃত আধ্যাত্মিকতার জন্ম হয়,সেটা সকলের নজরে আসে। তাঁকে সমস্ত অভিযোগ থেকে মুক্ত করে দেওয়া হয়।তিনি তারপর,শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংস দেব -এর লীলা সঙ্গিনী শ্রীমা সারদার সাথে বাগবাজারে দেখা করেন,প্রনাম করেন,এবং সেখান থেকে প্রথমে চন্দননগর,পরে পন্ডিচেরীতে আধ্যাত্মিক সাধনার জন্য চলে যান। পরে সেখানে তাঁকে দেখতে গিয়েছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। এবং বিপ্লবী নলিনী সরকার,দিলীপ কুমার রায়(কবি দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের পুত্র),শাস্ত্রীয় সঙ্গীত সাধক ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায়, নেতাজী সুভাসচন্দ্র বসু,বিজ্ঞানী জগদীশ চন্দ্র বসু, মেঘনাদ সাহা,ডঃ ভুপেন্দ্রনাথ দত্ত (স্বামী বিবেকানন্দের ভাই),মহাত্মা গান্ধী, খান আব্দুল গফফার খান (যিনি সীমান্ত গান্ধী নামে খ্যাত), জওহরলাল নেহরু, বল্লভভাই প্যাটেল,প্রমুখরা।
এইসব মানুষদের সাথে যখন সাক্ষাৎ হয়েছে তাদেরও শ্রী অরবিন্দের অনুরোধে কিছু না কিছু খেতে হয়েছে।আসলে তিনি নিজে স্বল্পাহারী এবং খেতে ভালোবাসতেন, তাই অন্যান্যদেরও তিনি খাওয়াতে ভালোবাসতেন। একই জীবনে শ্রী অরবিন্দ কতদিন না খেয়ে থেকেছেন, আবার কখনো কখনো বেশ পরিতৃপ্তি করে খেয়েছেন। আসলে তার মধ্যে যে বাঙালীয়ানার ছাপ ছিল, সেটা প্রমাণ হয়ে যায়।
প্রণাম রইল বিপ্লবী ঋষি শ্রী অরবিন্দের পবিত্র চরণে।