পঙ্কজ চট্টোপাধ্যায়
এত বিস্তৃত তাঁর লেখনী,অথচ বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে তিনি উপেক্ষিতা। অধিকাংশ বাঙালীই জানেনা তাঁর নাম।
এমন কি তিনি রাজনৈতিক ভাবে যে দলে যুক্ত ছিলেন তারাও এই মানুষটির নাম জানেন না। হয়তোবা মনে রাখে নি। আপাদমস্তক কমিউনিস্ট পার্টির ঘরানার মানুষ হয়েও,তিনি কমিউনিস্ট পার্টির কিছু কিছু বিচ্যুতি চিহ্নিত করায়,এবং সমালোচনা করায় সেই সময়ের পার্টির ওপরতলার নেতৃত্বের বিরাগভাজন হন এবং তিনি পার্টি ছেড়ে বেরিয়ে আসেন। তিনি, “স্বরলিপি ” নামক একটি উপন্যাসে পার্টির সেসব বিচ্যুতিগুলোকে চিহ্নিত করেন এবং সেইজন্য তাঁকে পার্টি এই বই টি প্রকাশ করতে নিষেধ করেন। কিন্তু তিনি নীতিতে ছিলেন অটল।তাই তিনি পার্টি ছেড়ে দেন।
সাবিত্রী রায়ের জন্ম ১৯১৮ সালের ২৯ শে এপ্রিল। অবিভক্ত বাংলার শরিয়াতপুরে সাবিত্রী জন্মগ্রহন করেন।
বাবার নাম ছিল নলিনীরঞ্জন সেন, আর মায়ের নাম ছিল সরযুবালা দেবী।
সাবিত্রী বি.এ,বি.টি. পাশ করার পরে দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের বিপ্লবীদের আন্দোলনের সাথে যুক্ত হন। পরে ১৯৪১ সালে কমিউনিস্ট পার্টির সাথে কাজ করতে শুরু করেন।
পাশাপাশি লেখার কাজেও তিনি নিজেকে নিয়োজিত করেন। তিনি তাঁর লেখায় বস্তুত নানা কাহিনীর উপকাহিনীর সমাহার।যাতে রয়েছে মন্বন্তর,সাম্প্রদায়িকতা, দেশভাগের কথা, ক্লিষ্ট দারিদ্র্যতা, ওরা-আমরা র তফাত, নেতা নেত্রীদের দ্বিচারিতা, ইত্যাদি, ইত্যাদি। কমিউনিস্ট মতাদর্শে স্থির থেকেই তিনি কমিউনিস্ট পার্টির আমলাতান্ত্রিক কর্তৃত্ব এবং পুরুষতান্ত্রিক আধিপত্য মেনে নিতে পারেন নি, তাঁকে ব্যথিত করেছে অবিরত। বামপন্থী পরিবারেও কেন নারীদের বেলায় সামন্ততান্ত্রিক মনোভাব স্থান পায়?কেন নারীকে পর্দার আড়ালে থাকতে হয়? পুরুষের পাশাপাশি থেকে কেন নারীকে সহযোগী সহযোদ্ধা রূপে প্রতিষ্ঠা করা হবেনা? কেন সেখানে প্রগতিশীলতার ভন্ডামি থাকবে?…সেইসব সামাজিক সীমাবদ্ধতা সাবিত্রী তুলে ধরেছেন তাঁর লেখায়।
সাবিত্রী রায়ের লেখা উপন্যাস ও বড় গল্প গুলির মধ্যে সৃজন( ১৯৪৭),স্বরলিপি, মালশ্রী,পাকা ধানের গান, মেঘনা-পদ্মা, সমুদ্রের ঢেউ,ঘাসফুল ও বদ্বীপ,অন্তঃসলিলা, ওরা সব পারে,উল্লেখযোগ্য। সাবিত্রী রায়ের গল্পগ্রন্থ “নতুন কিছু নয়” প্রকাশিত হয় ১৯৫২ সালে।এরপর লেখেন “নীল চিঠির ঝাঁপি” (১৯৮০)।
সাবিত্রী রায়ের জীবনের বিভিন্ন অভিজ্ঞতাই যেন উপন্যাস আর গল্পের চরিত্র হয়ে উঠে এসেছে লেখায়। মহিলাদের সংসার সুখের করতে চাকরি ছাড়া,সন্তান পালন,অসুস্থতা,অসহায়তা,
পরিবারে,বাইরের জগতে মতাদর্শগত বিরোধ–এইসবই কোনও না কোনও ভাবে তাঁর রচিত চরিত্রগুলোকে প্রভাবিত করেছে। জিজ্ঞাসা যেন জারি থাকে, এই ছিল তাঁর সাহিত্য ভাবনার প্রধান লক্ষ্য।
নীল চিঠির ঝাঁপি – তে তাই তিনি লিখলেন–“কতকাল,কত দীর্ঘকাল,আমার নিঃসঙ্গ ঘর থেকে রবীন্দ্রসঙ্গীত হারিয়ে গেছে,হারিয়ে গেছে মালকোশ, বাগেশ্রী, দরবারী কানাড়া।…বন্দিনী কিষানীর মতো আমি একা ঘরে ভীত চোখে চেয়ে দেখি বন্দীশালার সুউচ্চ গাঁথনী।”
সাহিত্যিক গল্পকার সাবিত্রী রায় বন্দীশালার গাঁথনী ভাঙতে চেয়েছিলেন প্রাণপণে। কিন্তু ১৯৮৫ সালের এক অমোঘ দিনে মৃত্যু সাবিত্রী রায়কে ছিনিয়ে নিয়ে গিয়েছিল এই লোক থেকে “জীবন মরনের সীমানা ছাড়ায়ে”…।
এখনও যেন সেই লড়াই জারি আছে সেইভাবেই বন্ধ,বদ্ধ খাঁচার পাখীটার…বিভিন্ন নামে, বিভিন্ন ঠিকানায়,বিভিন্ন বয়সের পরিচয়ে।
সাম্যবাদিনী,সময়ের পটুয়া,নিঃশব্দ জেদ নিয়ে বেঁচে থাকা সাহিত্যিক গল্পকার সাবিত্রী রায় কে মনে না রাখাটাই আমাদের অপদার্থতা, কলঙ্ক।যা আমাদের প্রায়শ্চিত্ত করা উচিত।
জীবন যন্ত্রনার শিল্পী গল্পকার সাবিত্রী রায়, আপনার জন্য রেখে গেলাম বিনম্র শ্রদ্ধা। পারলে আপনি আমাদের ক্ষমা করে দেবেন আপনার ক্ষমাসুন্দর অনুভবে।