প্রথম পাতা প্রবন্ধ শতবর্ষ প্রণামে স্মরণীয়া সুচিত্রা মিত্র

শতবর্ষ প্রণামে স্মরণীয়া সুচিত্রা মিত্র

606 views
A+A-
Reset

পঙ্কজ চট্টোপাধ্যায়

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অত্যন্ত স্নেহধন্য সাহিত্যিক সৌরীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায়ের কন্যা সুচিত্রা মুখোপাধ্যায় (পরে সুচিত্রা মিত্র) শান্তিনিকেতনে যখন গেলেন গান শেখার জন্য,তার কয়েকমাস আগেই চিরবিদায় নিয়ে চলে গেছেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ জীবন মরণের সীমানা ছাড়ায়ে..। মনে মনে সারাজীবন এই আক্ষেপ ছিল সুচিত্রার।কিন্তু তিনি শান্তিনিকেতনেই রয়ে গেলেন রবীন্দ্রনাথের গানেতে নিজেকে নিবেদন করার মনোবাসনায়। গান শিখলেন শান্তিদেব ঘোষ,এবং শৈলজারঞ্জন মজুমদারের কাছে। সেখানেই সুচিত্রার মোহর প্রাপ্তি ঘটেছিল। মানে পরিচয় হয়েছিল মোহর তথা কণিকা-র (কনিকা বন্দ্যোপাধ্যায়) সাথে। সেই সময়ে শান্তিনিকেতনের সংস্কৃতি ছিল, সকলে মিলে একসাথে কাজ করার। সে হলকর্ষণ থেকে বৃক্ষরোপন অবধি। একক গান পরিবেশনের জায়গাতে সমবেত বৃন্দগান সবাই মিলে গাওয়া, এই ছিল শান্তিনিকেতনের সেইসময়কার রেওয়াজ।

তাই বোধহয় সুচিত্রা মিত্র যখন কলকাতায় ফিরে এলেন, তখন তিনি নিজেকে গড়ে নিয়েছেন সেই মানুষ হিসাবে,যে মানুষ ভাবনায় চেতনায় এবং চেষ্টায় “সব কাজে হাত লাগাই মোরা সব কাজে..র মানসিকতার একজন মানুষ।

তখনকার দিনের ভারতীয় গণনাট্য সংঘের(আই.পি.টি.এ.) পথসভা, ‘রবিতীর্থ-‘র বিভিন্ন প্রযোজনা, যেমন তাসের দেশ, রবীন্দ্রভারতীর নানান কাজে থেকেছেন সবার সাথে,সবার পাশে,সবার সামনে। দায়িত্ব নিয়ে।

১৯৭৫ সালে আমেরিকার অনুষ্টান। তিনি ছিলেন একা আমন্ত্রিত। কিন্তু না।সুচিত্রা মিত্র নানান চেষ্টা চরিত্র করে পুরো “রবীতীর্থ”- কে নিয়েই গেলেন আমেরিকা।

সুচিত্রা মিত্রের কন্ঠের ব্যাপ্তি দেখেই বোধহয় বিশ্বখ্যাত সুরকার গীতিকার সলিল চৌধুরী করেছিলেন রবি ঠাকুরের ” কৃষ্ণকলি”- কবিতার সম্প্রসারণ। বিখ্যাত হয়েছিল সেই গান।

শহরে,মফস্বলে,গ্রামে গঞ্জে সুচিত্রা মিত্র গেয়ে বেড়াচ্ছেন মানুষের গান গণসঙ্গীত,রবীন্দ্রসঙ্গীত একসাথে।

সুচিত্রা মিত্রের বিশেষ গুণ ছিল,তিনি সকলকে নিয়ে সকলের সাথে একসঙ্গে কাজ করতে খুব ভালোবাসতেন। এইচ এম ভি- তে রবীন্দ্রনাথের চিত্রঙ্গদার মহড়াতে একসাথে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়,কনিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, এবং তিনি সন্তোষ সেনগুপ্তের সংগে আলোচনায় দায়িত্ব নিয়ে কাজ করেছেন। আবার কখনো দেখা যাচ্ছে সুচিত্রা মিত্র কাজ করছেন রবীন্দ্রনাথের চন্ডালিকা নৃত্যনাট্যের অনুশীলন চলাকালীন উৎপল দত্ত,কনিষ্ক সেনেদের সাথে রিহার্সালরুমে। দেবব্রত বিশ্বাসের পাশে দেবব্রত-র অত্যন্ত প্রিয় সুচিত্ররা মিত্র।
ছায়াচিত্রের অভিনয়েতেও তিনি সকলের সাথে স্বচ্ছন্দ্য সাবলীলভাবে। রবিতীর্থ- তে গানের ক্লাসে সুচিত্রার গলা খারাপ,দায়িত্ব দিলেন ছাত্রছাত্রীদের গান শেখানোর জন্য।
একসময় এই কলকাতা শহরের শেরিফ হয়েছিলেন। সসম্মানে,আপন যোগ্যতায় ছিলেন সেখানে বিরাজিতা।

বাঙলা ও বাঙালির কাছে সুচিত্রা মিত্র তাই চিরকাল একটি উচ্চতর,উচ্চতম মার্গের নাম,পরিচয়।

আগামী ১৯ শে সেপ্টেম্বর সুচিত্রা মিত্রের জন্মশতবর্ষ পূর্ণ হতে চলেছে। আজ শতবর্ষ পেরিয়েও সুচিত্রা মিত্র আপন মহিমায় মহিমান্বিতা হয়ে রয়েছেন আমাদের মনে,আমাদের মননে।

সুচিত্র মিত্রের কন্ঠে সেই গানগুলি বাঙালির মনের শ্রবনে আজও বেজে যায়–
” সার্থক জনম আমার জন্মেছি এই দেশে,সার্থক জনম মাগো তোমায় ভালোবেসে…”।

আর,বোধহয় চিরন্তন শাশ্বত সত্য হয়ে গেছে আমাদের কাছে সুচিত্রা মিত্রের সেই গান–” তবু মনে রেখো,…যদি দূরে যাই চলে,—তবু মনে রেখো…”

মনে রাখতেই হবে সুচিত্রা মিত্রকে।কারন সুচিত্রা মিত্র আমাদের অলঙ্কার, সুচিত্রা মিত্র আমাদের অহঙ্কার।

শতবর্ষের বিনম্র প্রণতি রেখে গেলাম সুচিত্রা মিত্রের চরণ ছুঁয়ে।

মন্তব্য করুন

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.