পঙ্কজ চট্টোপাধ্যায়
১৯৪৭ এর ১৫ই আগস্ট,সদ্য স্বাধীন ভারতবর্ষ। বলা যায় দ্বি-খন্ডিত ভারতবর্ষ। সবে জন্ম নিয়েছে পাকিস্তান। চারিদিকে রক্তক্ষয়ী জাতি দাঙ্গা। লাখো লাখো ঘরছাড়ানো উদবাস্তু। বিভিন্ন জায়গাতে খুন,ধর্ষন,ঘরবাড়ি জ্বলছে,লাশের পরে লাশ,সম্পত্তি বেদখলি,ইত্যাদিতে এই ভুখন্ডের মানুষ জর্জরিত,অসহায়। এক কথায় সময়টা এক ভয়াবহ।
দাঙ্গার সুত্রপাত ১৬ ই আগস্ট, ১৯৪৬। দেশের রাষ্ট্র নেতারা,রাজনৈতিক দলগুলি সেদিন ব্যস্ত ছিল বৃটিশের ষড়যন্ত্রের দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে অখণ্ড ভারতবর্ষের ভাগ বাঁটোয়ারাতে। একমাত্র ব্যতিক্রম যাঁরা ছিলেন তাঁদের অন্যতম ছিলেন মহাত্মা গান্ধী।
গান্ধীজি চাননি দেশটা ভাগ হোক। কিন্তু বাস্তবে বোধহয় তখন তাঁর আধিপত্য ভারতের রাজনীতিতে বহাল থাকলেও, তিনি প্রায় একা হয়ে পড়েছিলেন। তিনি সারা দেশের দাঙ্গা বিধ্বস্ত এলাকায় একা কতিপয় অনুগামীদের সাথে নিয়ে শান্তি আর সম্প্রীতির আবেদনের আর্জি জানিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু ভ্রাতৃঘাতী দাঙ্গার আগুন ক্ষনিকের জন্য স্তিমিত হলেও, নিভে যায় নি।
এহেন অবস্থায় স্বাধীন হোল দু-টুকরো ভারতবর্ষ। একদিকে ভারত,অন্যদিকে পাকিস্তান। কয়েকমাস যাবার পরেই পাকিস্তান ১৯৪৮ সালের জানুয়ারী মাসের একেবারে শুরুতে ভারতের কাশ্মীর ভূখন্ডে আগ্রাসন আক্রমণ চালালো। লাগলো দু দেশের মধ্যে যুদ্ধ। স্বাধীনতার সময়ে বৃটিশের উপস্থিতিতে ভারত নবগঠিত পাকিস্তানকে অর্থনৈতিক সাহায্য সহযোগিতা করবে এমন চুক্তি হয়েছিল। সেই সহায়তা ভারত সরকার করছিলেনও।কিন্তু কাশ্মীর নিয়ে পাকিস্তানের নক্কারজনক আক্রমনে ভারত সরকার সেই অর্থনৈতিক সাহায্য সহযোগিতা বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। তাতে মহাত্মা গান্ধী ক্ষুন্ন হলেন। তিনি এর বিরোধিতা করলেন।
অনেক রাজনৈতিক ঐতিহাসিকদের মতে এটাই ছিল গান্ধীজির অদূরদর্শীতা। গান্ধীজির এই বিরোধিতাকে ভারতবর্ষের হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে ক্ষোভের, উষ্মার জন্ম দিয়েছিল। গান্ধীজির ব্যক্তিত্বের প্রতি অনাস্থা তৈরী হয়েছিল। যদিও ঐ সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করার জন্য গান্ধীজি আমরণ অনশণে বসলেন ১৩ ই জানুয়ারী, ১৯৪৮। তৎকালীন ভারত সরকার গান্ধীজির চাপের কাছে নতি স্বীকার করে সেই সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করে নেয়।

ওদিকে তলে তলে সেই সময়ে এই পরিস্থিতিতে নাথুরাম গডসে এবং তার সহযোগীরা গান্ধীজিকে হত্যা করার পরিকল্পনা করে। প্রথমে তারা চেষ্টা করে ২০ শে জানুয়ারী, ১৯৪৮ সালে।কিন্তু অসফল হয়। পরে ১৯৪৮ এর ৩০ শে জানুয়ারী সেই কালো দিন।
গান্ধীজির নাতনী মৃদুলা গান্ধী (মনু বেন নামে পরিচিত) এবং গান্ধীজির দত্তক কন্যা আভা চ্যাটার্জি (আভা বেন– ইনি পরে গান্ধীজির ভাইপো কানু গান্ধীকে বিবাহ করেন)–এই দু’জন ৩০ শে জানুয়ারী, ১৯৪৮, গান্ধীজির হত্যার মুহূর্তে গান্ধীজির সাথে ছিলেন দিল্লির বিড়লা হাউসে। মনু বেন গান্ধীর স্মৃতি কথা ( লাস্ট গ্লিম্পসেস অফ বাপু// ১৯৬২ সালে প্রকাশিত) বইতে লিখছেন,সেদিন সকাল ৮ টায় বাপু স্নান করেন।তারপর কিছু খেয়ে তিনি অনেকের সাথে কথা বলেন
দুপুরে মধ্যাহ্ন ভোজ সারেন। তারপর একটু ঘুমিয়েছিলেন তিনি।ঘুম থেকে উঠে তিনি সর্দার দাদার সাথে একটি মিটিং করেন। তারপর সবাই চলে গেলে বাপু ডানদিকে মনু বেন আর বাম দিকে আভা বেনকে নিয়ে বিড়লা হাউসের প্রার্থনার স্থানের দিকে হাটতে শুরু করেন। দু’পাশে অনেক মানুষ তাকে নমস্কার করছেন। তিনিও প্রতি নমস্কার জানাচ্ছিলেন সকলকেই। এমন সময়ে হঠাৎ ভিড় ঠেলে খাঁকি পোষাকের এক ব্যক্তি গান্ধীজির সামনে এসে তাঁকে নীচু হয়ে প্রনাম করেই গুলি করে,পরপর তিনটে গুলি। গুলিতে গান্ধীজি লুটিয়ে পড়েন মাটিতে।রক্তে ভেসে যাচ্ছে চারিদিক।মনু বেন এবং আভা বেন দুজনেই ছিটকে পড়েন মাটিতে। মনুবেনের হাতের ঘড়িটিও ছিটকে পড়ে বন্ধ হয়ে যায়।পরে তিনি দেখেন সময়টা ছিল বিকেল ৫টা বেজে ১৭ মিনিট। মাটিতে লুটিয়ে পড়ার মুহূর্তে বাপুর মুখে ছিল শেষ শব্দ… “হা–য়–রা–আ–আ–ম…”।
কয়েক মিনিটের মধ্যেই সব শেষ।
জাতির জনকের নিষ্প্রাণ দেহটি পড়ে থাকে সদ্য স্বাধীন দেশের মাটিতে।
মহাত্মা ইতিহাস হয়ে গেলেন। শান্তির পুজারী,সত্যের পুজারী এক মহামানব।যিনি মনে প্রানে চেয়েছিলেন শান্তি,সম্প্রীতি আর সৌভ্রাতৃত্ব। যিনি চেয়েছিলেন… ” ঈশ্বর আল্লা তেরে নাম,। সবকো সন্মতি দে ভগবান…”।
আজ তার তিরোধানের দিনে জানাই প্রনাম। প্রার্থনা করি শান্তি,সম্প্রীতি আর মানুষে মানুষে ভালোবাসা স্বমহিমায় বিরাজ করুক গান্ধীজির এই দেশে, আমাদের এই ভারতবর্ষে।