পঙ্কজ চট্টোপাধ্যায়
গা ছমছম করা সেই সব কাহিনি লোকমুখে, জনশ্রুতিতে , কিম্বা গল্পে পরিচিতি লাভ করেছে। বাংলা সাহিত্যে,কবিতায়, চলচ্চিত্রে সেই সব ডাকাতদের কথা উল্লেখ আছে। তার মধ্যে সবিশেষ উল্লেখযোগ্য হল বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়-এর “দেবী চৌধুরানী”। এখানে রয়েছে ভবানী পাঠক আর দেবী চৌধুরানী। উত্তর বঙ্গের জলপাইগুড়ি জেলার উপকণ্ঠে শিকারপুর, বৈকুন্ঠপুরের মানুষরা বিশ্বাস করেন এবং বলেন যে এইখানেই ছিল দেবী চৌধুরানী তথা অবিভক্ত বাংলার রংপুর জেলার মন্থনীর রাজবধু পরে স্বামী পরিত্যক্তা জয়দুর্গা দেবী চৌধুরানীর (আশ্রয় পেয়েছিলেন সৎ ব্রাহ্মণ ভবানী পাঠকের/দুই সহচরী ছিল ” দিবা”(আসলে ললিতা),আর “নিশি” (আসলে উমাবতী)।) “শ্মশান কালীর মন্দির আজও রয়েছে।
হুগলীর আরামবাগের কাছে রয়েছে তেলো ভেলোর মাঠের কাছে ভীমে ডাকাতের মন্দির,যার সাথে শ্রীশ্রী মা সারদার সেই অলৌকিক কাহিনী জড়িত।দক্ষ্মিণেশ্বরে স্বামী শ্রীরামকৃষ্ণ-এর কাছে যাবার জন্যে পায়ে হেটে আসার পথে ঘন জঙ্গলের মধ্যে ১৩/১৪ বছরের মা সারদা ক্লান্তিতে বসে পড়েন,আর তখনই দেখা হয় ভীমে ডাকাতের সঙ্গে। তাকে শ্রীমা “বাবা” বলে সম্বোধন করেন, ডাকাতের স্ত্রীকে “মা” বলে ডাকেন। তারাও দেখতে পান শ্রীসারদার মুখে মা কালীর মুখ। তারপর সে এক ইতিহাস। সেখানে আজও সেই ডাকাত কালির মন্দির আছে। সেখানে মায়ের নিত্যভোগ হয় মুড়ি,মুড়কি, চালভাজা,বাতাসা দিয়ে।কারণ সেদিন সেই রাতে খুব খিদে পাওয়ায় মা সারদা তার সেই ডাকাত মা-বাবার কাছে ঐ খাবারই চেয়ে খেয়েছিলেন।
আরামবাগের খানাকুলের কাছে রয়েছে প্রায় ৪০০ বছরের প্রাচীন কাঞ্চন ডাকাতের সিদ্ধেশ্বরী কালী মন্দির।
হুগলীর বাঁশবেড়িয়ায় ত্রিবেনীতে রয়েছে রঘু ডাকাত,বিশে ডাকাত, আর বোদে ডাকাতের নাম জড়িয়ে। এবং সেই নামগুলির সাথে সংযুক্ত রয়েছে সাধক রামপ্রসাদ এবং সাধক কমলাকান্ত-র নাম।
কলকাতার বুকে খিদিরপুর থেকে একটু দূরে হাইড রোডের ওপরে একটি কালী মন্দির আজও আছে, যার ঠিকানা ৯৪/২, সারকুলার গার্ডেনরিচ রোড। এই মন্দির প্রায় ৩৪০ বছরের প্রাচীন। এটি ছিল রঘু ডাকাতের মন্দির। তার আত্নীয় শবসাধনায় তন্ত্রসাধনায় সিদ্ধপুরুষ যোগী গোলকনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় (শর্মা) এখানে পরে পুজো করতেন। মন্দির ফলকে লেখা রয়েছে, “কার্ত্তিক মাসের কৃষ্ণপক্ষের অমাবস্যায় শ্রী গোলকনাথ দেবশর্মা কৃত্ত স্থাপিত। ১৬৫৫ শকাব্দ,সন ১১৪০ বঙ্গাব্দ।”
কলকাতায় মনোহরপুকুর রোড। এখানে রয়েছে একটি ৪০০ বছরের প্রাচীন কালী মন্দির।কথিত আছে,যে এটি মানুহর বা মনোহর ডাকাতের প্রতিষ্ঠিত। তার নাম অনুসারে এই জায়গার নামকরণ হয়েছে।
একই ইতিহাস পাওয়া যায় কলকাতার চিৎপুর অঞ্চলের চিত্তেশ্বরী কালীমন্দির বা চিত্তেশ্বরী দুর্গা বাড়ির সম্বন্ধে। তখন মোগল আমল, জাহাঙ্গীর-এর রাজত্ব। সেই সময়ে এখানেই বসবাস ছিল চিতু ডাকাতের।আসল নাম চিত্তেশ্বর রায়। সেই নামেই এলাকার নাম করা হয়েছে।
শ্রীচৈতন্যদেবের মামার বাড়ি বেলপুকুরে বা বিল্বপুষ্করিনী গ্রামে সুপ্রাচীন এক ডাকাতে কালীর মন্দির আজও বহমান। আশেপাশে,শান্তিপুর,নবদ্বীপ, বুড়ো শিবতলায়,কাঁসারীপাড়ায়,
কাশ্যপ পাড়াতে ডাকাতে কালীর মন্দির আজও রয়েছে।
কলকাতার টালিগঞ্জ এলাকাতে সিরিটি শ্মশানেও অতি প্রাচীন ডাকাতে কালীর মন্দির আজও রয়েছে।
সেই যুগে গঙ্গার পূর্ব পাড়ে ছিল গভীর জঙ্গল।দিনের বেলাতেই ছিল হিংস্র পশুদের চলাফেরা। তখনকার সুতানুটির(এখনকার বাগবাজার শোভাবাজার অঞ্চল) পাশেই ছিল সেই ভয়ংকর এলাকা।এখানেই বাস করতো ডাকাতের দল। এই দলের দলপতি ছিল নন্দরাম ঘোষ। নন্দরামের বাড়ি ছিল বাগবাজারের খালের পাশে কাঁটাপুকুর এলাকাতে। তার দলে ছিল স্থানীয় গোয়ালা,হাড়ি,ডোম,বাগদি, এমন কি পর্তুগীজ-ওলন্দাজ জাতি গোষ্ঠীর লোকজন। সে প্রায় ৮৫০ বছর আগেকার কথা। বাগবাজারের কালী মন্দির সেই নন্দরামেরই প্রতিষ্ঠা।
ডাকাতদের যুগ শেষ হয়ে যাওয়ার অনেক পরে, বাগবাজারের এই সিদ্ধেশ্বরী কালীমন্দিরে আজ থেকে ১৫০-৬০ বছর আগে প্রায়শই আসতেন শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব। “বসুমতী” সাহিত্য মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা উপেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়কে শ্রীরামকৃষ্ণ উপদেশ দিয়ে বলেছিলেন,” তুই মা সিদ্ধেশ্বরীর কাছে মানত্ কর,যেন তোর এক দরজা শত দরজায় পরিণত হয়।” উপেন্দ্রনাথ তাই করেছিলেন।তারপর বসুমতী সাহিত্য মন্দির শত ধারায় বিকশিত হয়েছিল বাংলা সাহিত্যে,সংবাদপত্র জগতে।
ব্রাহ্মনেতা কেশবচন্দ্র সেন একবার অসুস্থ হলে শ্রীরামকৃষ্ণ দক্ষিণেশ্বরের মা ভবতারিণীর কাছে আর বাগবাজারের মা সিদ্ধেশ্বরীর কাছে “ডাব ও চিনি মানত্” করেন।
মহাকবি গিরীশচন্দ্র ঘোষ তার প্রতিটি নাটক সবার আগে উৎসর্গ করতেন মা ভবতারিণীকে এবং মা সিদ্ধেশ্বরীকে। গিরীশচন্দ্র ডাকাত কালী সিদ্ধেশ্বরী মাকে আদর করে ডাকতেন “বাগবাজারের গিন্নী-মা” বলে।
অবিভক্ত বাংলার অনেক জায়গাতে ডাকাতে কালীর মন্দির বহু প্রাচীন কাল থেকে আজও রয়েছে। সেগুলির প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন বাংলার সেই সময়ের গরীব সাধারণ মানুষের ভগবান আর অত্যাচারী ধণী দেশী-বিদেশীদের যম সেইসব ডাকাতের দল। সে এক ঐতিহ্যময় ইতিহাস। যা শুনলে বা জানলে আজও রোমাঞ্চিত হতে হয়।