প্রথম পাতা প্রবন্ধ এক ঐতিহাসিক প্রতিবাদের বীর বিপ্লবীর আত্মবলিদানের কাহিনি…

এক ঐতিহাসিক প্রতিবাদের বীর বিপ্লবীর আত্মবলিদানের কাহিনি…

1.2K views
A+A-
Reset

পঙ্কজ চট্টোপাধ্যায়

১৯১৯ সালের ১৩ই এপ্রিল।নৃশংস নিরপরাধ মানুষের অপর নির্বিচারে, মর্মান্তিকভাবে গুলি চালিয়ে হত্যাকাণ্ডের বিরল ঘটনা পাঞ্জাবের জালিয়ানওয়ালাবাগ।

এই ঘটনায় সেদিন প্রতিবাদে সোচ্চার হয়েছিলেন একমাত্র বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। নাইট উপাধি ত্যাগের সাথে সাথে কড়া ভাষায় লিখেছিলেন প্রতিবাদের চিঠি তখনকার বড়লাট লর্ড চেমসফোর্ড-কে। গান্ধী, নেহরু, প্যাটেল, চিত্তরঞ্জন দাশ, প্রমুখ সহ কংগ্রেসের কোনও নেতানেত্রী সেদিন এর প্রতিবাদ করেনি, এটাই আসল সত্য ইতিহাস।
ভারতবর্ষ, এশিয়া-সহ সারা বিশ্ব ক্ষোভে বিক্ষোভে ফেটে পড়েছিল। কিন্তু ব্রিটিশ সরকার আর তার বশংবদ পাঞ্জাবের গভর্নর মাইকেল ও ডায়ার এবং হত্যাকাণ্ডের মূল কুচক্রী ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মাইকেল আর. ডায়ার অট্টহাসি দিয়ে দম্ভোক্তি করেছিল..”আমাদের কাছে সেদিন এক হাজার দুশো পঞ্চাশ রাউন্ড গুলির মধ্যে আর একটাও অবশিষ্ট ছিলনা। থাকলে তারও সদ্ব্যবহার করতাম।…আর, সেটা করতে পারলে আমাদের চেয়ে বেশি খুশি আর কেউ হত না।”

শুধু তাই নয়,বিলেতের হাউস অফ লর্ডস এর পক্ষ থেকে অভিনন্দন জানিয়েছিল সেদিন এই নরাধমদের। আর, বিলেতের অভিজাত “ভদ্দরনোকেরাও” কম যায়নি সেদিন, তারা তখনকার দিনে ২৬ হাজার পাউন্ড পুরস্কার দিয়েছিল এই হত্যাকারীদের।

এরা সুসভ্য জাত?ছিঃ ছিঃ ছিঃ…

কিন্তু আমাদের দেশের চিরাচরিত পরম্পরাগত অভ্যাসে একসময়ে সেই প্রতিবাদী ক্ষোভ বিক্ষোভ স্তিমিত হয়ে গিয়েছিল, ভুলেও গিয়েছিল অনেকেই।

কয়েকজন শুধু ভোলেনি। তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন সেদিনের একটি ১৪/১৫ বছরের কিশোর। তার মনে চিন্তা চেতনায় জন্ম নিয়েছিল এক প্রতিজ্ঞা…এর বদলা চাই…এর বদলা নিতেই হবে একদিন না একদিন।

তারপর কেটে গেল ২১ টা বছর। এখন সেই কিশোর ৩৫/৩৬ এর যুবক। সে এখন ইঞ্জিনিয়ার। সে বসবাস করছে লন্ডনে। সে কি মনে রেখেছে তার সেদিনের সেই শপথ? উত্তর হলো অবশ্যই। শুধু তাই নয়,সে খোঁজ নিয়ে জেনেছে যে ব্রিগেডিয়ার মাইকেল আর.ডায়ার ইতিমধ্যেই আত্নহত্যা করে পরপারে চলে গেছে। বাকি রয়েছে গভর্নর মাইকেল ও ডায়ার, যে সেদিন জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের মুলচক্রী। অপেক্ষায় ছিল সেই যুবক।দিন যায়,মাস যায়,অনেক প্রতীক্ষার পরে অবশেষে এলো সেইদিন,ঘৃন্য জঘন্য নরপিশাচকে খতম করার সেইদিন।

সেদিন ছিল ঐতিহাসিক দিন।১৯৪০ সালের ১৩ই মার্চ।

বিলেতের ক্যাক্সটন হলের টিউডর হলে সেদিন হয়েছিল খুব ভিড়। কারণ,ইস্ট ইন্ডিয়া এসোসিয়েশন এবং রয়েল সেন্ট্রাল এশিয়ান সোসাইটির উদ্যোগে এক সভা আয়োজন করা হয়েছে সেখানে। বিষয়বস্তু –ভারতবর্ষ সহ দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার রাজনৈতিক পরিস্থিতি। সভাপতি লর্ড জেটল্যান্ড। প্রধান বক্তা মাইকেল ও’ডায়ার।সেই কুখ্যাত গভর্নর।
ঠিক বিকেল ৫টা।সভা শুরু হোল। জেটল্যান্ড উঠে দাঁড়িয়ে শুরু করলেন–“লেডিস এন্ড জেন্টলম্যান…. “। সভায় এলেন মাইকেল ও’ডায়ার। সেই নররক্তলোভী শয়তান। মঞ্চে বসলেন,অনেক বড় বড় ভাষণ দিলেন।

এক সময়ে সভা শেষ। এবার নেমে আসছে লর্ড জেটল্যান্ড, তার আগে আগে মাইকেল ও’ডায়ার। একটু একটু করে এগিয়ে যাচ্ছে অনেকেই। তার মধ্যে সেই যুবকও এগিয়ে যাচ্ছেন। যুবকের চোখে ভাসছে ২১ বছর আগেকার সেই ভয়াবহ নরহত্যার ঘটনা.. জালিয়ানওয়ালাবাগ এর রক্তাক্ত,আর্তনাদের মূহুর্তের দৃশ্যগুলি। চোখে তার স্থির দৃষ্টি…শুধু সেই খুনী মাইকেল ও ডায়ার-এর দিকে। সহসা যুবকের রক্তে আগুন ধরে গেল। একদম সামনা সামনি সেই যুবক আর মাইকেল ও ডায়ার। বুঝি এক লহমার ব্যাপার। চোখের পলক ফেলতে না ফেলতেই সেই যুবকের হাতের রিভলবার সশব্দে গরজে উঠল–দ্রাম্..দ্রাম্..দ্রাম্…।

এক গুলিতেই শেষ। তবু সবকটা গুলিই সেদিন সেই যুবকটি শেষ করলেন ডায়ার-কে লক্ষ্য করে। শত্রুর শেষ রাখতে নেই। ব্যস, রক্তাক্ত ডায়ারের লাশ পড়ে রইল মাটিতে।

চারদিকে হৈচৈ। পালাও পালাও।বাঁচতে চাও তো এক্ষুনি পালাও।সবাই হলের বাইরে ছুটছে। কিন্তু একজন শুধু নির্বিকার।তিনি হলেন সেই যুবকটি। অতি ধীর স্থিরভাবেই ব্রিটিশ পুলিশের হাতে ধরা দিলেন তিনি। জীবনের একমাত্র সাধ,লক্ষ্য তাঁর আজ পূর্ণ হয়েছে।তিনি আজ সুখী, সার্থক,বিজয়ী।

খবর ছড়িয়ে পড়ল দেশে দেশান্তরে। পরাধীন ভারতের মানুষ যে যেখানে সেদিন ছিল সকলেই মনে মনে,গোপনে বলে উঠলো সাবাস। সাবাস। হে বিদ্রোহী বীর তুমি দেখালে বটে এক কাণ্ড। তোমার তুলনা নেই। তুমি আমাদের গৌরব।

কিন্তু,কে এই বীর বিদ্রোহী যুবক?কি তার পরিচয়?

বিচার শুরু হোল। ম্যাজিস্ট্রেট জিজ্ঞাসা করলেন “কি নাম তোমার? কাগজপত্র থেকে তো জানা যাচ্ছে তোমার নাম রাম মহম্মদ সিং আজাদ।তুমি একজন ইঞ্জিনিয়ার। তাই তো?”সেই বিদ্রোহী যুবক কিন্ত নিরুত্তর।

অবশ্য অনেক পরে জানা গেল যে,সেই বিপ্লবী বীরের নাম “উধম সিং”। তিনি কোন জাতপাত মানতেন না বলেই নিজে নিয়েছিলেন এক ছদ্মনাম… “রাম মহম্মদ সিং আজাদ”।তিনি শুধু পাঞ্জাবের নন,তিনি সারা ভারতবর্ষের। তিনি শুধু শিখ নন,তিনি শিখ,হিন্দু,মুসলিম সহ সকল সম্প্রদায়ের। তিনি ভারতমাতার অমর বীরপুত্র।

ফাঁসির আগে সেলে থাকাকালীন বেশ কয়েকজন ব্রিটিশ অফিসার উধম সিং-কে বলেছিলেন.. “কনগ্র‍্যাচুলেশন মাই ফ্রেন্ড। যেভাবে তুমি তোমার দেশের জাতীয় অবমাননার প্রতিশোধ নিয়েছো,তার জন্য তোমাকে স্যালুট করি।তোমাকে শ্রদ্ধা করি অন্তর থেকে।সত্যিই তুমি একজন বিশ্বের সেরা প্যাট্রিয়ট।”

বিচারের নামে প্রহসনের শেষে ওল্ড বেইলী সেন্ট্রাল ক্রিমিনাল কোর্ট রায় দিল–মৃত্যুদণ্ড। উধম সিং-এর চোখে-মুখে এক অপার অসীম আনন্দ।তার কাজ শেষ। এবার বিদায় নেবার পালা।বিদায় জন্মভূমি ভারতবর্ষ। বিদায় নিলাম আমার দেশের দেশবাসীর কাছ থেকে। আমাকে মনে রাখলে কি রাখলে না আমার তাতে এতটুকু দুঃখ নেই,শুধু আমার জন্মভূমিকে স্বাধীন কোরো, মাতৃভুমিকে যত্নে রেখো,ভালো রেখো।এই আমার প্রার্থনা। ইনকিলাব জিন্দাবাদ।বিদায় বন্ধু বিদায়।

১৯৪০ সালের ১লা জুন বীরের মতোই বুক টানটান করে পেন্টনভেলি জেলের ফাঁসির মঞ্চে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন ভারতবর্ষের বিদ্রোহী বিপ্লবী সন্তান রাম মহম্মদ সিং আজাদ তথা উধম সিং।

নিজের কর্তব্য পালন করে বিদায় নিলেন তিনি। সেই খবর শোনার পরে শ্রদ্ধায় মাথা নুইয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ, নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু,রাসবিহারী বসু,সীমান্ত গান্ধী খান আবদুল গফফার খান,মৌলানা আবুল কালাম আজাদ,হেমচন্দ্র ঘোষ,সত্য বক্সি,ডঃ ভুপেন্দ্রনাথ দত্ত(স্বামী বিবেকানন্দের ছোট ভাই),শ্রী অরবিন্দ, বিপ্লবী মুজফফর আহমেদ,মাস্টার দা সূর্য সেনের স্ত্রী,পাঞ্জাবের আর এক বীর শহীদ ভগৎ সিং এর মা,শহীদ চন্দ্রশেখর আজাদের পরিবার,শহীদ রাজগুরুর পরিবার,শহীদ রামপ্রসাদ বিসমিলের পরিবার,শহীদ ক্ষুদিরামের দিদি অন্নপূর্ণা দেবী,শহীদ আশফাকুল্লার পরিবার,প্রমুখ…প্রমুখরা। মাথা নুইয়েছিলেন পাঞ্জাবের পঞ্চনদ।সারা ভারতবর্ষ, সারা এশিয়া।মাথা নোয়াল কোটি কোটি নিপীড়িত নির্যাতিত মানুষ।
ধন্য রাম মহম্মদ সিং আজাদ তথা উধম সিং। তুমি ধন্য।তোমার আত্মবলিদান ভারতবর্ষের ইতিহাসে চির অমর,চির অক্ষয়,চির অব্যয় হয়ে লেখা থাকবে চিরকাল।

মন্তব্য করুন

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.