বিদ্যাসাগর বাঙালী হয়েও ‘বাঙালী’ ছিলেন না

আজ থেকে প্রায় ২০০ বছরেরও বেশী আগেকার কথা। তখন আমাদের এই বাঙলায় তথা আমাদের এই দেশে শিক্ষা বলতে কিছুই ছিল না। ছিল না দেশের বেশীরভাগ মানুষের অন্ন-বস্ত্রের সংস্থান, সমাজ শুধু কু-সংস্কারের নানা রকমের বিধি নিষেধের অন্ধকারে আচ্ছন্ন ছিল।জমিদার,রাজা-রাজড়াদের আর তাদের উমেদারদের শোষন উৎপীড়নে দেশের অসংখ্য গরীব প্রজাদের সে এক অভিশপ্ত জীবন যাপনের সময় ছিল তখন। মেয়েদের তো আরও করুন অবস্থা।  তাদের জীবন ছিল অতি মর্মান্তিক। তখনকার সমাজের সমাজপতিদের নির্দেশে মেয়েদের বিয়ে হোত ৫/৬ বছর বয়সে। এক একজন পুরুষ বিয়ে করতো একাধিক।তারপর, অল্প বয়সে অনেক মেয়ে বিধবা হোয়ে যেত,তখন তাদের জীবনে নেমে আসতো এক যন্ত্রনাদায়ক বৈধব্য জীবনের অবস্থা।কারো কারো  জীবনে নেমে আসতো লাঞ্চনা-গঞ্জনা,আবার কারো কারো জীবনের ইতি ঘটতো সতীদাহ-র নামে জীবন্ত পুড়ে মরা। সেসব এক অমানবিক ইতিহাস।তখন এদেশে,এই বাংলাতে, বৃটিশের রাজত্ব।

ঠিক এই সময়ে এদেশের মাটিতে এসেছিলেন এক ক্ষণজন্মা পুরুষ—ঈশ্বর চন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় তথা ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। জন্ম নিলেন তিনি এই বাংলার মেদিনীপুর জেলার বীরসিংহ গ্রামে,১৮২০ সালের ২৬ শে সেপ্টেম্বর, মা ভগবতী দেবীর কোল আলো করে।বাবার নাম ছিল ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায়।

অত্যন্ত গরীব ঘরের সন্তান ঈশ্বরচন্দ্র নিজের অদম্য এবং অনমনীয় সাহসী,একরোখা মানসিকতায় নিজেকে জীবনে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন তাঁর শিক্ষায়,ভাবনায়, মননশীলতায়। সেইযুগে বা বলা যায় সর্বযুগেই আর পাঁচজন বাঙালীর মতো তিনিও পারতেন আত্মসর্বস্ব,আত্মসুখী আটপৌরে জীবন কাটাতে। কিন্তু তিনি ছিলেন তার বিপরীতে। তাই,তৎকালীন এই দেধের,এই বাঙলার সমাজব্যবস্থায় যে সমস্ত কূপমন্ডুকতা,কুসংস্কার,অশিক্ষার হীনমন্যতা শতকের পর শতক  জাঁকিয়ে বসেছিল। সেগুলিকে এক এক করে উৎপাটিত করে তিনি সংস্কারের দুরুহ কাজে প্রায় এককভাবে নিজেকে নিয়জিত করেছিলেন। আজকের আমাদের সারা দেশের সমাজব্যবস্থায়,সবিশেষ এই বাংলায় সব দিক দিয়ে যে উন্নতি আমরা দেখছি বা ভোগ করছি….তার পথিকৃৎ হিসাবে রাজা রামমোহন রায়,একথা অবশ্যই সত্য, কিন্তু তার পাশাপাশি আরও বড় সত্য হোল সেই সংস্কারের মহাযজ্ঞের উপযুক্ত একমাত্র মহা-ঋত্বিক হলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। তাইতো তিনি আজ ২০০ বছর পরেও বাংলা ও বাঙালীর কাছে তথা সারা ভারতবর্ষে এখনও অতি উজ্জ্বলভাবে প্রাসঙ্গিক।

পুরুষের বহুবিবাহ বন্ধ করা,বিধবাদের আবার বিয়ে দেওয়া,মেয়েদের অল্প বয়সে বিয়ে দেওয়ার রীতি বন্ধ করা,সমস্ত স্তরের নারী-পুরুষের নির্বিশেষে লেখাপড়া শেখার জন্য তিনি বাঙলার গ্রামে গ্রামে, বিহারের ছোটনাগপুরের কারমাটারে এবং তার আশে পাশে নারী পুরুষের জন্য ১০১২ টি স্কুল তৈরী করা,এই বাঙলায় শুধু মেয়েদের জন্যে ১৩৫ টি বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা,২০ টি মডেল স্কুল করা,শিক্ষাদানের জন্য শিক্ষা শিক্ষন স্কুল “নর্মাল স্কুল”(এখনকার বি.এড. এর সমতুল্য),প্রতিষ্ঠা করা,সারা বাঙলাতে তথা ভারতবর্ষে “নৈশ বিদ্যালয়”তৈরী করা,বাঙলা ভাষার আধুনিক বর্ণমালা তৈরী করা এবং তা ছাপার অক্ষরে বইতে পরিনত করা.. “বর্ণ-পরিচয়”(প্রথাম ভাগ এবং দ্বিতীয় ভাগ),  “বোধোদয়”, সংস্কৃত ভাষার উন্নতি ঘটানো, তার জন্য  “ব্যাকরন কৌমদী” বই ইত্যাদি লেখা,ইংরাজি সাহিত্যের বিখ্যাত নাট্যকার উইলিয়াম শেক্সপীয়ার-এর লেখা এদেশে প্রথম অনুবাদ করা( The Comedy of Errors এর ভ্রান্তিবিলাস), সমবায় প্রতিষ্ঠান স্থাপন করা,অসহায় বিধবা মহিলাদের আর্থিক সাহায্যের জন্য এদেশে প্রথম ইন্সিওরেন্স-এর ভাবনার প্রতিষ্ঠা করা,সেই সময়ের শাসক ইংরেজদের অন্যায়-অনাচারের বিরুদ্ধে সজোরে প্রতিবাদ করে এদেশের স্বাভিমান ঐতিহ্যকে সম্মানিত করা,যেকোন দীন-দুঃখীকে বা অসহায় মানুষকে সব দিক দিয়ে সাহায্য করা,এদেশীয় রক্ষনশীল সমাজের মাতব্বরদের অন্ধ কুসংস্কার এবং নীচুতলার মানুষদের ওপর তাদের অন্যায় অবিচারের প্রতিবাদ করা,ইত্যাদি ইত্যাদি কর্মকান্ড ছিল এই পুরুষ-সিংহের জীবনের সফল এবং সার্থক ব্রত।

অবশ্য এই সব কাজের জন্য তাঁকে অনেক প্রতিকুল অবস্থারও মুখোমুখি হতে হয়েছিল  বহুবার,এমনকি তাঁকে অপদস্তও হতে হয়েছে,শুনতে হয়েছে সমালোচনা,গালিগালাজ,ঘরে-বাইরে শত্রুদের হাতে লাছিত,অপমানিত হতেও হয়েছে,এমন কি তাঁকে খুন হওয়ার চক্রান্তের সামনা-সামনিও হতে হয়েছে।তাঁর ঘর বাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে,ইত্যাদি ইত্যাদি। আর এই সব অপ-কান্ডগুলি সেদিন যারা করেছিল তারা কেউ বিদেশী ছিলেন না,সকলেই তারা বিদ্যাসাগরের তথা আমাদের এদেশেরই লোক ছিলেন,সমাজের সমাজপতির দল আর তাদের বশংবদ তাঁবেদারদের দল।কিন্তু শেষমেশ জয় হয়েছে ঈশ্বরচন্দ্র  বিদ্যাসাগরেরই। একটি প্রামান্য নিদর্শন থেকেই বোঝা যায় যে, বিধবাদের আবার বিয়ে করার আইন,এবং মেয়েদের লেখাপড়া শেখার আইন প্রনয়নের প্রস্তাবের বিপক্ষে তখনকার সমাজের প্রায় ৩৭ হাজার স্বাক্ষরিত মত ছিল,আর বিদ্যাসাগরের শুভ  প্রস্তাবের পক্ষে ছিল মাত্র ৯০০ জনের স্বাক্ষরিত মত। আজ ভাবলে অবাক হতে হয় যখন দেখি আমাদের এই বঙ্গে বা সারা দেশে মেয়েরা শিক্ষা সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে কতো এগিয়ে যাচ্ছে,আত্মনির্ভরশীল হচ্ছে,তখন মনে মনে সেই মহান মানুষটির পায়ে শত কোটি প্রনাম জানাতে ইচ্ছে করে।

তাঁর সারাজীবনের এই সমস্ত কাজের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়েই স্বয়ং শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব নিজে বিদ্যাসাগরের কলকাতার বাদুড়বাগানের বাড়িতে এসেছিলেন,বলেছিলেন, “এতদিন আমি খাল,বিল নদ নদী দেখে হদ্দ হয়ে গেছি,আজ আমি দেখলাম সাগর-কে,মহাসাগর-কে,বিদ্যার সাগর,করুণার সাগর,দয়ার সাগর-কে।”

রবীন্দ্রনাথ শিশুবেলায় পড়েছিলেন বর্ণপরিচয়…তিনি   সেই স্মৃতি রোমন্থন করে লিখেছেনঃ-” তিনি পল্লী আচারের ক্ষুদ্রতা,বাঙালী জীবনের জড়ত্ব, সকল ভেদ করিয়া…করুণার অশ্রুসজল উন্মোক্ত অপার মনুষ্যত্বের অভিমুখে আপনার দৃঢ়নিষ্ঠ একাগ্র জীবনকে প্রবাহিত করিয়া লইয়া গিয়াছিলেন… তিনি বাঙালী বড়লোক ছিলেন না,তিনি যে রীতিমতো হিন্দু ছিলেন তাহাও নহে,-তিনি তাহা অপেক্ষা অনেক বেশি বড় ছিলেন,

তিনি যথার্থ মানুষ ছিলেন। তিনি যেন বাঙালী হয়েও বাঙালী ছিলেন না। কারণ এই জাতির বৈশিষ্ঠ হোল কোন কিছু শুরু করে তাহার সমাপ্ত করার ব্যাপারে অনীহা। বিদ্যাসাগর ছিলেন তাহার ব্যতিক্রম, ‘‘তিনি যাহা আরম্ভ করিতেন তাহা শত বাধা অতিক্রম করিয়াও সফলতার সহিত সুসম্পন্ন করিতেন।”

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিদ্যাসাগরের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে লিখেছিলেন কবিতা।

” বঙ্গ সাহিত্যের রাত্রি স্তব্ধ ছিল তন্দ্রার আবেশে,/ অখ্যাত জড়তমভাবে অভিভূত।কী পূণ্য নিমেষে /তব শুভ অভ্যুদয়ে বিকিরিল প্রদীপ্ত প্রতিভা/প্রথম আশার রশ্মি নিয়ে এল প্রত্যুষের বিভা,/ বঙ্গভারতীর ভালে পরালে প্রথম জয়টীকা,/ রুদ্ধ-ভাষা আঁধারের খুলিলে নিবিড় যবনিকা।/হে বিদ্যাসাগর,পূর্ব দিগন্তের বনে উপবনে,/ নব উদ্বোধন গাথা উচ্ছ্বসিল বিস্মিত গগনে।”

আর এক মহান ব্যক্তি মাইকেল মধুসূদন দত্ত-ও বিদ্যাসাগরের প্রতি কৃতজ্ঞতায় “বিদ্যার সাগর তুমি বিখ্যাত ভারতে,করুনার সিন্ধু তুমি সেই জানে মনে,..”

মাইকেল আরো লিখেছিলেন..” The.genius and.wishdom of.an ancient sage, the energy of an English man and the heart of a Bengali mother..”

 জীবনের শেষ ১৪ বছর।পরিবারের এবং এই বাঙালী জাতটার প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে বিদ্যাসাগর চলে গিয়েছিলেন বিহারের কারমাটারে,সেখানে তিনি শেষ জীবন কাটিয়েছিলেন সেখানকার আদিবাসীদের সাথে,তাদের সাথে তাদেরই একজন হয়ে।

আন্তর্জাতিক স্তরে ইংল্যান্ডের BBC (British Broadcasting Corporation) র একটি তথ্যে জানা যায় যে শ্রেষ্ঠ ১০০ জন ভারতীয় তথা বাঙালীর নামের তালিকাতে প্রথম স্থান সমাদৃত করে আছেন।ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর।

আজ ২০১ তম আবির্ভাব বছরে বীরসিংহের সিংহশিশু  বিদ্যাসাগরের প্রতি রইল বাঙলা ও বাঙালির অপরিসীম অপরিশোধ্য ঋণ স্বীকার করে শত কোটি বিনম্র প্রণাম।

Related posts

‘মহিষাসুরমর্দিনী’- কিছু অজানা কথা

‘ইন্ডিয়া দ্যাট ইজ ভারত’, কিছু ঐতিহাসিক তথ্য

তিনিই ছিলেন একমাত্র “ঐক্যপুরুষ”